মিনহাজ আমান

রিসার্চ-লিড, ডিসমিসল্যাব
শেখ হাসিনার চিঠিটি ভুয়া: ভারতীয় গণমাধ্যম আবার যেভাবে বোকা বানাল
This article is more than 3 months old

শেখ হাসিনার চিঠিটি ভুয়া: ভারতীয় গণমাধ্যম আবার যেভাবে বোকা বানাল

মিনহাজ আমান

রিসার্চ-লিড, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদের বরাতে বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দিয়েছেন এবং তিনি সেই চিঠিতে, ক্ষমতা হারানোর জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। তবে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এক টুইটে জানিয়েছেন, এই চিঠি তার মায়ের নয় এবং দেশ ছাড়ার আগে বা সে সময়ে তিনি এমন কোনো বক্তব্য দেননি। 

১১ আগস্ট বাংলাদেশের বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, জনগনের উদ্দেশ্যে এক খোলা চিঠিতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “আমি পদত্যাগ করেছি, শুধু মাত্র লাশের মিছিল যেন আর না দেখতে হয়।” চিঠিতে আরো লেখা ছিল, “ক্ষমতায় আমি থাকতে পারতাম যদি ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’ আর ‘বঙ্গোপসাগর’ আমেরিকার হাতে ছেড়ে দিতাম,” 

প্রথম আলো, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, মানবজমিন, ইত্তেফাক ডয়চে ভেলে বাংলাসহ বেশকিছু গণমাধ্যম ভারতীয় সংবাদ সূত্র দিয়ে খবরটি প্রকাশ করেছে। মানবজমিন, ডয়চে ভেলে বাংলা এবং ইত্তেফাক কোনো নাম না বলে সাধারণভাবে ভারতীয় গণমাধ্যমকে সূত্র হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। তবে ইনডিপেনডেন্ট এবং প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতের গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টের নাম উল্লেখ করা হয়। 

অবশ্য শুধু দ্য প্রিন্ট নয়, এনডিটিভি, আজতক, আনন্দবাজারহিন্দুস্তান টাইমস বাংলা সহ ভারতের ডজনের বেশি গণমাধ্যম খবরটি প্রকাশ করে। এদের মধ্যে দ্য প্রিন্টের খবরের শিরোনাম ছিল: “ব্রেকিং সাইলেন্স আফটার আউস্টার, শেখ হাসিনা অ্যাকিউজেস ইউএস এন্ড ওয়ার্নস ইন্টেরিম গভ অ্যাগেইন্সট বিয়িং ‘ইউজড’।” যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, “উৎখাতের পর প্রথম মুখ খুললেন শেখ হাসিনা, দোষ দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘ব্যবহৃত’ না হতে সতর্ক করলেন।” 

প্রতিবেদনটি লিখেছেন, পিয়া কৃষ্ণনকুট্টা। খবরটির এক জায়গায় তিনি লেখেন, “তিনি (শেখ হাসিনা) শনিবার আওয়ামী লীগ সমর্থকদের প্রতি এক বার্তায় এসব বলেছিলেন, যা দ্য প্রিন্ট দেখেছে।” কিন্তু কোথায় দেখেছে বা কি সূত্র, তার কিছুই তিনি উল্লেখ করেননি। সূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সংবাদমাধ্যমটির রাজনীতি সম্পাদক ডিকে সিংকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠায় ডিসমিসল্যাব। তবে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। 

এনডিটিভিও খবরটি প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল: শেখ হাসিনা’স আনডেলিভার্ড স্পিচ হ্যাড বিগ চার্জ এগেইন্সট ইউএস। খবরটির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, “এখন ভারতে থাকা এই ৭৬ বছর বয়সী (হাসিনা) তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে এই না-বলা বক্তৃতা নিয়ে কথা বলেছেন যা এনডিটিভির কাছেও রয়েছে।”

একই দিনে খবরটি প্রকাশ করে দ্য হিন্দুস্তান টাইমস। সেখানেও কোনো সূত্রের উল্লেখ নেই। তাদের খবরে যোগ করা হয়, “নয়াদিল্লিতে অজ্ঞাতবাসে থেকেই বিবৃতি দিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক সব অভিযোগ করেছেন হাসিনা।”

এই চিঠির সূত্র খুঁজতে গিয়ে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায়, গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এটি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং কোনো সূত্র ছাড়াই। সবচেয়ে পুরোনো যে পোস্ট পাওয়া যায়, সেটি গত ৬ আগস্ট দুপুর একটার দিকে একটি ব্যক্তিগত আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে। পত্রিকায় উল্লেখিত চিঠির সঙ্গে ফেসবুকের এই চিঠি হুবহু মিলে যায়। একইদিন, চিঠিটি বরুড়া.টিভি এবং ওয়ান্স এগেইন শেখ হাসিনা নামের দুটি ফেসবুক পেজ থেকেও পোস্ট করা হয়।

সেই রাতে ‘সোজু টুডে’ নামের একটি ফেসবুক পেজ শেখ হাসিনার কথিত চিঠিটি প্রথমে ইংরেজি ভাষায় পরে বাংলায় প্রকাশ করে। তারাও বলেছে, চিঠিটি ভারতীয় সংবাদসূত্র থেকে পাওয়া, তবে তারা দেশটির কোনো গণমাধ্যমের নাম উল্লেখ করেনি। ভারতীয় গণমাধ্যমে চিঠিটি নিয়ে খবর প্রকাশের পর, তারা পুরোনো পোস্টটিকে আবার শেয়ার করে এবং দাবি করে তাদের আগের পোস্ট সঠিক ছিল। খবরের সূত্র জানতে চেয়ে পেজটিতে বার্তা পাঠানো হলেও তারা কোনো উত্তর দেয়নি। 

সূত্রহীন এই চিঠির সত্যতা জানতে ডিসমিসল্যাব থেকে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মোবাইলে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি ফিরতি উত্তর দেননি, তবে বার্তা পাঠানোর ঘন্টাখানেক পরেই নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দেন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিঠিটিকে ভুয়া বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত হয়েছি, তিনি (শেখ হাসিনা) ঢাকা ছাড়ার আগে বা পরে এমন কোনো বক্তব্য দেননি।”

এর আগে সজীব ওয়াজেদ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। 

এরপরে ডয়চে ভেলে বাংলা, “শেখ হাসিনার পদত্যাগ সংক্রান্ত বিবৃতিটি ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’” শিরোনাম দিয়ে ভুল খবরটিকে সংশোধন করে। খবরটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন শিরোনাম ছিল: ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায় দিলেন শেখ হাসিনা।

এর আগে, গত ৬ আগস্ট শেখ হাসিনার আরেকটি কথিত চিঠি নিয়ে খবর প্রকাশ করে ভারতীয় গণমাধ্যম ডেকান ক্রনিকল। খবরটিতে বলা হয়, হাসিনার এই চিঠি তার কাছের লোকজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল। খবরে দাবি করা হয়, শেখ হাসিনা কথিত সেই চিঠিতে বলেছেন, “আমি দেশ ও জনগণের স্বার্থে পদত্যাগ করছি। আমি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে চেয়েছিলাম বা অন্তত জনগণকে আমার বিদায় হিসেবে একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করতে চেয়েছিলাম। সুযোগ পাইনি। আমি অশুভ শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিলাম।” সম্প্রতি আলোচিত ভুয়া চিঠির সঙ্গে অবশ্য এটির ভাষার কোনো মিল নেই।

অবশ্য ভারতীয় গণমাধ্যমের সূত্রহীন ও মিথ্যা খবর প্রকাশ করা বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমের জন্য নতুন নয়। এর আগে পাকিস্তান বাংলাদেশের ত্রাণ সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেছে – এমন দাবি করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের এক ডজনের বেশি সংবাদমাধ্যমে একটি খবর প্রকাশিত হয়। ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের তিনটি গণমাধ্যমের খবরকে কোনো রকম যাচাই না করে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইসলামাবাদে কূটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করে যে বাংলাদেশের ত্রাণ প্রত্যাখ্যান করার খবরটি ছিল ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’।

আপডেট: ১২ আগস্ট, ডিসমিসল্যাবের পাঠানো বার্তার জবাবে দ্য প্রিন্ট জানায় যে, তারা এই প্রতিবেদনটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

আরো কিছু লেখা