তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
শিক্ষিকাকে সন্তান নেওয়ার আগে প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিতে হবে না
This article is more than 2 years old

একটি বিভ্রান্তিকর শিরোনাম থেকে ভুয়া খবরের বিস্তার

শিক্ষিকাকে সন্তান নেওয়ার আগে প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিতে হবে না

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

ফেসবুকে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পেজে “কোনো শিক্ষিকাকে সন্তান নেওয়ার আগে প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিতে হবে”- এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি নির্দেশনা ভেবে অনেকেই খবরটি শেয়ার করছেন; এটিকে বিশ্বাস করে হাজার হাজার মানুষ তাতে মন্তব্য করেছেন। এসব পোস্টের বেশিরভাগেই (, , , , ) কোনো সূত্র বা প্রেক্ষাপটের উল্লেখ নেই। 

যাচাই করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে, একটি দৈনিক পত্রিকা মূলত বিভ্রান্তিকর শিরোনামটি দিয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে; তারপর শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্ট একটি জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ শুধু সেই শিরোনামের বাক্যটি দিয়ে একটি পোস্ট ছেড়েছে; পেজটি থেকে পোস্টের কমেন্ট সেকশনে খবরটির একটি অংশ হুবহু তুলে ধরা হলেও, মাত্র একদিনে মূল সূত্র ও প্রেক্ষাপট ছাড়াই হাজার হাজার ব্যবহারকারী শুধু শিরোনামের সেই একটি বাক্য শেয়ার বা পোস্ট করেছেন। আর এভাবে একটি বিভ্রান্তিকর শিরোনাম থেকে একটি ভুয়া খবর জন্ম নিয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভুয়া তথ্য পাঠকদের বিভ্রান্ত করেছে ও তাদের মনে ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়েছে।

খবরটি কোথা থেকে এলো

সাধারণ গুগল সার্চেই দেখা যায়, খবরটি প্রথম প্রকাশিত হয় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, দৈনিক যুগান্তরে। “কোনো শিক্ষিকা বাচ্চা নিলে প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিতে হবে!” শীর্ষক খবরটি মূলত বাংলাদেশের একটি জেলার, একটি স্কুলের, একটি যৌন হয়রানির অভিযোগকে নিয়ে। কিন্তু খবরের শিরোনামে কেবল একটি আশ্চর্যবোধক চিহ্ন জুড়ে দিয়ে বিষয়টিকে সাধারণীকরণ করা হয়েছে।

মূল খবর অনুয়ায়ী, নওগাঁর মহাদেবপুরের চকরাজা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসাইন এমন মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে একজন শিক্ষিকা লিখিতভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন। অন্যান্য শিক্ষিকাদের বক্তব্য: ওই প্রধান শিক্ষক সহকর্মী শিক্ষিকাদের সন্তান নেওয়ার আগে তার অনুমতি নিতে হবে বলেও হুমকি দেন। 

শিরোনামে ঘটনাস্থলের নাম উল্লেখ না করার কারণে পাঠকের মনে এমন ধারণা তৈরি হওয়ার শঙ্কা থাকে যে বাংলাদেশের সব স্কুলের শিক্ষিকাদের বুঝি বাচ্চা নেয়ার আগে তাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিতে হবে।

মিডিয়া রিসার্চ ও এডভোকেসি প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ড্রাফটের সংজ্ঞা মতে, বেশি ক্লিকের আশায় খবরের শিরোনামে চটকদার ভাষা ব্যবহারের এই চর্চাকে ক্লিকবেইট বলে, যেখানে শিরেনামের সঙ্গে মূল সংবাদের তেমন মিল পাওয়া যায় না। এই সংবাদটির ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটেছে। যৌন হয়রানি সংবাদের মূল বিষয় হলেও এখানে শিরোনাম বাছাইয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করার বিষয়টিই মাথায় রাখা হয়েছে। আর দিন শেষে মূল খবর বাদ দিয়ে শুধু শিরোনামটিই “তথ্য” হিসেবে ছড়ানো হয়েছে।

খবরটি যেভাবে ছড়াল

খবরটি কিভাবে ভাইরাল হলো, তা খুঁজতে গিয়ে ‘বাংলাদেশ শিক্ষাবার্তা’ নামের একটি পেজে “কোনো শিক্ষিকাকে বাচ্চা নিতে হলে অনুমতি লাগবে প্রধান শিক্ষকের!”- লেখা একটি পোস্ট পাওয়া যায়। প্রকাশের পর মাত্র একদিনে, অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি নাগাদ পোস্টটি ছয় হাজারের বেশি বার শেয়ার হয়। 

এই পেজের নাম ও প্রোফাইল ছবিতে সরকারি লোগো রয়েছে। ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। পেজটি প্রায়ই ক্লিকবেইট হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন চটকদার শিরোনাম ফেসবুক পোস্ট হিসেবে শেয়ার করে থাকে।

বাংলাদেশ শিক্ষাবার্তার মূল পোস্টটি মাত্র এক বাক্যের। তাতে কোনো সূত্র, সংশ্লিষ্ট ছবি, বা প্রেক্ষাপটের উল্লেখ নেই। তবে সেই পোস্টের মন্তব্য সেকশনে পেজটির পক্ষ থেকে যুগান্তরে প্রকাশিত খবরটির বিস্তারিত তথ্য হুবহু তুলে ধরা হয়। কিন্তু সেই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে গিয়ে দেখা যায়, ততক্ষণে অনেক ব্যবহারকারী একে সরকারি সিদ্ধান্ত ভেবে মন্তব্য করে যাচ্ছেন।

যেমন: সুমাইয়া আক্তার নামের একজন কমেন্টে লিখেছেন, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কেমন অযৌক্তিক আইন… তাহলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আগামী প্রজন্ম কী শিক্ষা গ্রহণ করবে? মানুষ তো হবেই না, কিন্তু কতটা অমানুষে পরিণত হবে এখন এটাই ভাবার বিষয়।”

জেবা খান নামে আরেক জন লিখেছেন, “এটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে কারো হস্তক্ষেপ বা অধিকার দেওয়ার নিয়মটা পছন্দ হলো না।”

মোহাম্মদ ওয়াহিদ উজ জামান লিখেছেন, “গর্দভ সন্তানদের যখন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন এরকম সিদ্ধান্ত আসাটাই স্বাভাবিক”।

অনেক পেজ শুধুমাত্র বাংলাদেশ শিক্ষাবার্তার পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে সেটি পোস্ট করেছে। ফলে সেখান থেকে কমেন্ট সেকশন যাচাইয়েরও কোনো উপায় ছিল না। পেজটির নাম ও  প্রোফাইল ছবিতে সরকারি লোগো ব্যবহারের কারণেও অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ শিক্ষাবার্তা ছাড়াও বেশ কয়েকটি পেজ একই ধরনের পোস্ট শেয়ার করে। জহিরুল ইসলাম সজল নামের একজনও একই পোস্ট লিখেছেন। তবে তিনি এই পোস্টের সঙ্গে (নতুন ঘোষণা) লিখে দুটি বাড়তি শব্দ যোগ করেন।

একইভাবে শফিকুল ইসলাম হাবিবি নামের একজন বক্তা তার ফেসবুক পেজে লেখেন, “নাউজুবিল্লাহ…কোনো শিক্ষিকাকে বাচ্চা নিতে হলে অনুমতি লাগবে, প্রধান শিক্ষকের!” তার ফলোয়ার সংখ্যা ৭২ হাজারের বেশি।

পোস্টটিতে হাবিবুল্লাহ নামে একজন মন্তব্য করেন, “আরও কতো কিছু শুনতে হবে আমাদের এই দেশে। নিজের স্বাধীনতা জিনিসটা আমাদের আর থাকলো না।” 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক মাধ্যমে বেশিরভাগ ব্যবহারকারী সাধারণত শিরোনাম দেখেই সত্য-মিথ্যা সিদ্ধান্ত নেন এবং খবরটি শেয়ার করেন। বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই লিংকে ক্লিক করে মূল খবর পড়েন না।

আরো কিছু লেখা