নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

মো. তৌহিদুল ইসলাম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের খবরে বিভ্রান্তি

বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের খবরে বিভ্রান্তি

নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

মো. তৌহিদুল ইসলাম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ অবস্থানে বা শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে বলে সম্প্রতি দেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে (, , , ৪, ) খবর প্রকাশিত হয়। গত ৪ আগস্ট, খবরটি নিজস্ব প্রতিবেদন আকারে প্রথম প্রকাশ করে দৈনিক প্রথম আলো। পরে ডেস্ক বা অনলাইন প্রতিবেদন হিসেবে আলাদা খবর প্রকাশ করে দৈনিক কালবেলা, কালের কণ্ঠ, দেশ রূপান্তর ও ডেইলি সান সহ একাধিক সংবাদমাধ্যম। প্রতিবেদনগুলােতে মূল তথ্য, ভাষ্য ও এমনকি কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্যও প্রায় একই।

প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে। একটি পক্ষ দাবি করে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে যা এই সরকারের ব্যর্থতা; আরেক পক্ষের দাবি হলো, প্রকাশিত খবরের তথ্যগুলো পুরোনো, যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। 

খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে প্রতিবেদন

সংবাদে বলা হয়েছে, এই তথ্যের মূল সূত্র হলো গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫ এবং জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)-র অপর আরেকটি প্রতিবেদন। ডিসমিসল্যাব, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সঙ্গে সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত মূল দুটি প্রতিবেদন মিলিয়ে দেখতে পায়, খবরে একাধিক তথ্যগত ভুল রয়েছে এবং প্রেক্ষাপট ছাড়া তথ্য উপস্থাপন করায় সেখান থেকে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা নিয়ে প্রথম আলোর রিপোর্ট

তথ্যগত ভুল

প্রথম ভুল তথ্য হলো, খবরের মূল সূত্র ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ নিয়ে। সংবাদে দাবি করা হয়, এটি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা মিলে: এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ। কিন্তু প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার নয়। এটি প্রকাশ করেছে ফুড সিকিউরিটি ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক  (এফএসআইএন) এবং প্রতিবেদনের “কৃতজ্ঞতা” অংশে বলা হয়েছে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস (জিএনএএফসি) এটি প্রকাশে সহায়তা করেছে। প্রতিবেদনটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজনে ভূমিকা রেখেছে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলেপমেন্ট (ইফাদ)।

খবরের দ্বিতীয় ভুল তথ্য হলো, দ্বিতীয় সূত্র হিসেবে দাবি করা এফএওর আরেকটি প্রতিবেদন নিয়ে। প্রথম আলোর খবরে দাবি করা হয়, “জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেওয়া ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ শীর্ষক পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।” কিন্তু যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, এফএওর প্রতিবেদনটির নাম আসলে ‘দ্যা স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড -২০২৫’। এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জাতিসংঘের পাঁচ সংস্থা (এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফ) মিলে।

এফএসআইএন এবং এফএও-এর প্রতিবেদন

তথ্যে তৃতীয় সমস্যা হলো, কখন রিপোর্ট দুটি প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে। খবরে বলা হয়, “দুটি প্রতিবেদনই গত এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।” সেই হিসেবে খবর প্রকাশের দিন, অর্থাৎ ৪ আগস্টের, এক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের প্রকাশিত হওয়ার কথা। কিন্তু গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫ প্রকাশিত হয় ২০২৫ সালের মে মাসে। আর এফএওর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২৮ জুলাই, যা সংবাদ প্রতিবেদনের দেওয়া সময়ের সঙ্গে মেলে। তবে “১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ” – এই তথ্যের মূল উৎস যে প্রতিবেদন, সেটি ২ মাসেরও বেশি পুরোনো।

প্রকাশিত খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মূল রিপোর্ট দুটি মেলালে বোঝা যায়, খবরটি মূল অংশ তৈরি করা হয়েছে এফএওর ‘দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড -২০২৫ এর ওপর ভিত্তি করে। তবে কোনো সংবাদেই এর নাম নেই। এফএওর প্রতিবেদনে, ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ থেকে তথ্য উদ্বৃৃত করা হয়েছে। “১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ” – তথ্যটি তাদের প্রতিবেদনের ১২ পাতায়, একটি বক্সে প্রসঙ্গ হিসেবে এসেছে। এ অংশটিকেই সংবাদে অনুবাদ করা হয়েছে। আর এভাবে দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।

অর্থাৎ, উৎস গুলিয়ে ফেলার কারণে ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’-কে ভুলভাবে জাতিসংঘের পাঁচ সংস্থার প্রকাশনা বলা হয়েছে। খবরের আসল সূত্র “দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড – ২০২৫” হলেও (যা পাঁচ সংস্থা মিলে প্রকাশ করেছে এবং যার প্রকাশের তারিখ খবরের সঙ্গে মেলে) খবরে এর নাম নেই। বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় কোন অবস্থানে আছে – এই তথ্যের মূল উৎস আসলে প্রথম প্রতিবেদন, যা দ্বিতীয় প্রতিবেদনে উদ্ধৃত হয়েছে। প্রাথমিক উৎস থেকে সরাসরি তথ্য না নেওয়ায়, প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্য বাদ পড়ে গেছে।

প্রেক্ষাপটের অভাবে বিভ্রান্তি

কালের কণ্ঠ ও প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিটি খবরের মূল বিষয় হলো তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশ শীর্ষ পাঁচ দেশের একটি। দৈনিক দেশ রূপান্তর ও কালবেলা শিরোনাম করেছে – “বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় চতুর্থ বাংলাদেশ” আর ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি সান বলেছে, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশের র‌্যাংক বা অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ।

এই তথ্যটি এসেছে গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫ থেকে। তবে প্রতিবেদনটির কোথাও কোনো র‌্যাংকিং বা তালিকার কথা বলা হয়নি। তারা ৬৫টি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার অবস্থা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছে, এবং ৫৩টি দেশে জিআরএফসি পর্যাপ্ত তথ্য পেয়েছে বা তাদের নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করেছে। ৫৩টি দেশের পরিস্থিতি নিয়েই প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে।

এফএও গ্লোবাল ইনফরমেশন অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (জিআইইডব্লিউএস)–এর ২০২৪ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী যেসব দেশের বাইরের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছে তাঁদেরকে এই প্রতিবেদনের জন্য বাছাই করা হয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়াও যেসব দেশ বা অঞ্চলের ২০২৪ সালে হিউম্যানিটারিয়ান রেসপন্স প্ল্যান (এইচআরপি) বা মানবিক প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা ছিল তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি বিবেচনা করা হয়েছে এমন কিছু নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশ ও অঞ্চলকে যারা ২০২৪ সালে জরুরি সহায়তার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে ও পেয়েছে। তবে উচ্চ আয়ের দেশগুলোকে বিবেচনা করা হয়নি। কারণ ধরে নেওয়া হয়েছে এসব দেশ বাইরের সহায়তা ছাড়াই সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে।

এফএও এর প্রতিবেদন

প্রথম চিত্রটি দেখাচ্ছে, জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের যে ১০টি দেশে উচ্চ পর্যায়ের তীব্র খাদ্য নিরাপত্তহীনতা রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ চার-এ। হিসেবটি ২০২৪ সালের “পিক” এর – অর্থাৎ, ২০২৪ সালের মধ্যে কোনো একটি সময়ে প্রতি দেশে যতজন মানুষ চরম খাদ্য সংকটে ভুগেছে, তার সর্বোচ্চ সংখ্যা। চিত্রটি মূল প্রতিবেদন থেকে নেওয়া হয়েছে। 

এতে বলা হচ্ছে, ২০২৪ সালের একটি চরম সময়ে বাংলাদেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। এবং চিত্রটি সংখ্যার হিসেবে। দ্বিতীয় চিত্রটি, জনসংখ্যার শতাংশ হারে কোন দেশ বা অঞ্চলে কত তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষ রয়েছে তার হিসেব। এখানে বাংলাদেশের নাম প্রথম দশে নেই।

প্রকাশিত খবরগুলোতে এই তথ্যের প্রেক্ষাপট নেই, যা মূল সূত্র, গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫-এ পরিস্কারভাবে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মূলত ২০২৩ সালের শেষাংশ ও ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা এই হিসেবে পৌঁছেছেন। এই প্রতিবেদনের ১২১ পাতায় শুধু বাংলাদেশ নিয়েই একটি অংশ রয়েছে। সেখানে যা বলা হয়েছে, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়: 

২০২৪ সালে, বিশ্লেষণে দেখা গেছে বাংলাদেশের ২৩.৬ মিলিয়ন মানুষ, অর্থাৎ প্রায় ২৬% মানুষ, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। এদের মধ্যে ১.৬ মিলিয়ন ছিলেন জরুরি পরিস্থিতিতে ( যা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় চেয়েও খারাপ অবস্থা)। এই হিসাবের মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী জনগণও আছে। তাদের মধ্যে ৩০% (প্রায় ৩ লাখ) উচ্চ পর্যায়ের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার চরম মৌসুম ধরা হয়, কিন্তু বারবার বন্যা ও ঝড়ের কারণে এবার (২০২৪ সালের) অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের দিকেই পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়। ২০২৩ সাল থেকে আইপিসি বিশ্লেষণে নতুন করে বন্যাক্রান্ত অনেক জেলা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সংখ্যাটি একলাফে বেড়ে গেছে। বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে খাদ্য সংকট বেড়েছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আবহাওয়ার চরম প্রভাবের কারণে।

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ও বাংলাদেশ

সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার যে তিনটি প্রধান কারণ মূল প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, সেগুলো হলো: ২০২৪ সালের মে মাসে সাইক্লোন রেমাল, মাঝ-আগস্টের বন্যা এবং সংঘাতের কারণে নতুন করে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন। এছাড়া, ২০২৩ সাল থেকে আইপিসির বিশ্লেষণে বাংলাদেশের অনেক জেলা নতুন করে যুক্ত হয় এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পও এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫ এই তথ্য নিয়েছে আইপিসি ক্লাসিফিকেশন বা “সমন্বিত খাদ্য নিরাপত্তা পর্যায়” উদ্যোগ থেকে। আইপিসি বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে যুক্ত এবং অন্তত একবার আইপিসি বিশ্লেষণ বা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে এমন দেশগুলোর সংখ্যা ৫৫টি, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।। ২১টি আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলে এই পরিসংখ্যান নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করে, যার একটি উন্মুক্ত ডেটাবেসও রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর-এ প্রায় ২ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ (সংগ্রহিত নমুনার ২৬%) উচ্চ পর্যায়ের তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় (সম্মিলিতভাবে ফেজ থ্রি ও ফোর)-এ ছিলেন। তবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে এই সংখ্যা কমে প্রায় ১ কোটি ৫৫ লাখে (নমুনার ১৬%) দাঁড়িয়েছে। আইপিসি বলছে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এটি সামান্য বেড়ে জনসংখ্যার ১৭% এ দাঁড়াতে পারে, যার অন্যতম কারণ হবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য অনিশ্চয়তা।

সংবাদে প্রেক্ষাপট না থাকায় যা হলো

সংবাদে তথ্যের প্রেক্ষাপট না থাকায়, সামাজিক মাধ্যমে একেকজন একেকভাবে এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ভেবেছেন এটি বর্তমানের চিত্র, আবার কেউ বলেছেন পুরোনো তথ্য দিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। কেউ কেউ একে সংবাদ মাধ্যমের এজেন্ডা-সেটিং হিসেবেও অভিযোগ করেছেন।

প্রতিক্রিয়াগুলো মূলত দুই ধরনের। একটি অংশ দাবি করছে, প্রতিবেদনের তথ্য অতিরঞ্জিত, পুরোনো বা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মিল নেই। তাদের মতে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি খাদ্য ঘাটতি বা দুর্ভিক্ষের মতো নয়। উদাহরণস্বরূপ, “বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে” বা “জনগণ অভুক্ত থাকছে” এমন দাবিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে একজন ব্যবহারকারী লিখেন, “এই তথ্যের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। দুর্ভিক্ষ বা অভাবগ্রস্ততার মতো সংকটের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘমেয়াদি ফসলহানি, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক খাদ্য আমদানির ব্যর্থতা, অথবা চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশে বর্তমানে এমন কোনও পরিস্থিতি নেই।”

সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি

আরেকটি অংশের মতে, সরকারের ব্যর্থতার কারণেই বাংলাদেশে খাদ্য নিরপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যেমন, ফেসবুকে একজন লিখেছেন, “আমরা শীর্ষ যে পাঁচ দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছি তা কিন্তু অনবদ্য এবং অনন্য।” আরেক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশকে এক বছরে ‘খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শীর্ষ ৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ’-এ উন্নীত করার বিশাল সাফল্যের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও তাকে সমর্থনকারী বিএনপি জামাত এবং লাল বদরদেরকে আবার নোবেল পুরষ্কার দিন! আর গলায় নোবেল ঝুলিয়ে, পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিন!” আরেকটি পোস্টে বলা হয়,  “অথচ ২০২৪ এর জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ ছিলো! এক বছরে এ-ই যদি হয় অবস্থা তাইলে… থাক, ভাইবেন না… উপভোগ করেন….”। 

শিক্ষার্থীদের জন্য দরকারী তথ্য হিসেবেও প্রতিবেদনগুলােকে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন: ‘45th BCS’ নামে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক গ্রুপে একটি পোস্টের মাধ্যমে, সংবাদমাধ্যমে  প্রকাশিত প্রতিবেদনটির তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয় (৬) । এতে লেখা হয়, “ ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫ জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার (এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ) যৌথভাবে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পৃথক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ৫৩টি সংকটাপন্ন দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে চতুর্থ।”

আইপিসির পাঁচ পর্যায়

এই আন্তর্জাতিক কাঠামোটি খাদ্য নিরাপত্তার অবস্থাকে পাঁচটি পর্যায়ে (ফেইজ) ভাগ করে, এবং সেখান থেকে বোঝা যায়, মানুষ কোথায়, কতটা খাদ্য সংকটে আছে।

  • পর্যায় ১: কোনো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা নেই বা খুব সামান্য। পরিবারগুলো সহজে প্রয়োজনীয় খাবার পায়।
  • পর্যায় ২: কিছুটা চাপ থাকলেও পরিবারগুলো টিকে থাকতে পারে, খাদ্য গ্রহণ সীমিত হলেও জীবিকায় বড় প্রভাব পড়ে না।
  • পর্যায় ৩: সংকট, বড় ধরনের খাবারের ঘাটতি আছে, অপুষ্টি দেখা দেয়; খাদ্য চাহিদা পূরণে সম্পদ বিক্রি বা ধার করতে হয়।
  • পর্যায় ৪: জরুরি অবস্থা, অপুষ্টি ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি, জরুরি সহায়তা ছাড়া টিকে থাকা কঠিন।
  • পর্যায় ৫: দুর্ভিক্ষ বা বিপর্যয়, মারাত্মক খাদ্যাভাব ও অনাহারে মৃত্যুর হার বেশি, জীবন বাঁচানোও কঠিন।
খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত পাঁচটি পর্যায়

‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস (জিআরএফসি) ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে যে চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি মূলত পর্যায়-তিনের। এই পর্যায়টি এতো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সেই বিন্দু যেখানে সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের যেতে পারে। অর্থাৎ, সংকটময় পরিস্থিতিতে তা জরুরি অবস্থা বা দুর্ভিক্ষে রূপ নিতে পারে। 

পর্যায়-চারে থাকা দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশ, আট নম্বরে। এই পর্যায়ে মানুষদের চরম খাদ্য সংকট, অপুষ্টি ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে, যেখানে জরুরি সহায়তা ছাড়া টিকে থাকা কঠিন। জিআরএফসির তথ্য অনুযায়ী, এই পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশের ১৬ লাখ মানুষ যার মধ্যে সর্বাধিক এসেছে বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম জেলা থেকে। একই পর্যায়ের সর্বপ্রথমে অবস্থান করছে সুদান। দ্বিতীয়তে রয়েছে আফগানিস্তান। বাকী দেশগুলো হলো যথাক্রমে– ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো, মায়ানমার, দক্ষিণ সুদান, পাকিস্তান ও হাইতি। এরপরেই অবস্থান বাংলাদেশের। আর নয় নম্বরে রয়েছে ইয়েমেন। উল্লেখ্য, যেসব দেশের ১০ লাখের অধিক জনসংখ্যা এই পর্যায়ে রয়েছে, কেবল তাঁদেরকেই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।   

জিআরএফসি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিলিস্তিন (গাজা), সুদান, দক্ষিণ সুদান, হাইতি এবং মালি – এই পাঁচটি দেশে মানুষ পঞ্চম পর্যায় বা চরম দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।

আরো কিছু লেখা