মিনহাজ আমান

বাবর আজমের কথিত সেক্সটিং, নিমো যাদব এবং দেশি-বিদেশী গণমাধ্যম
মিনহাজ আমান
প্রায়শই তিনি টুইট করে মজা নেন। তবে সেই মজা না বুঝে কোন কোন মিডিয়া নিউজ করে বসে। আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে দেখা যায় খবরটি ভুয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও পর্যন্ত তার করা টুইটে বোকা বনে গিয়েছেন! এবার পাকিস্তান ক্রিকেটের অধিনায়ক বাবর আজমকে নিয়ে করা টুইটে তো দেশি-বিদেশী মিডিয়ার ‘মান-সম্মান’ নিয়ে টানাটানি অবস্থা!
কি ঘটেছে – তা জানার আগে টুইট করা অ্যাকাউন্টটি সম্পর্কে জেনে আসি।

“ড. নিমো যাদব” নামের একটি ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকে এমন টুইট করা হয়। তবে অ্যাকাউন্টটির ইউজারনেম নিরব মোদি (@niiravmodi)। এটি একটি ছদ্ম নাম। আসলে নিরব মোদি হচ্ছেন একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী; যিনি প্রায় ২ বিলিয়ন ভারতীয় রুপি পাচারের দায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯ সালের মার্চ থেকে তিনি লন্ডনের ওয়ান্ডসওয়ার্থ জেলে আটক আছেন।
স্যাটায়ার বা ব্যাঙ্গাত্নক টুইট করার জন্যই এই অ্যাকাউন্টটি করা। এবং তা নিয়মিত করা হয়। অ্যাকাউন্টের বায়োতে লেখা: প্যারোডি অ্যাকাউন্ট, অ্যাথলেট, গবেষক, প্রাক্তন রঞ্জি প্লেয়ার, ফ্যাক্ট-চেকার, আইআইটি কেজিপি। তারপরও তার করা টুইটে বিভ্রান্ত হন অনেকেই। বড় বড় গণমাধ্যমও। বাবর আজমকে নিয়ে করা টুইট তেমনি একটি।
গত ১৬ জানুয়ারিতে করা সেই টুইটে একটি ছবি ও ভিডিও দিয়ে বলা হয়, “বাবর আজম আরেকজন পাকিস্তানী ক্রিকেটারের গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে সেক্সটিং করছেন। এবং তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে তার বন্ধু দল থেকে বাদ পড়বে না, যদি তিনি তার সঙ্গে সেক্সটিং চালিয়ে যান…”
টুইটটি ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনি। গণমাধ্যম যখন টুইটটিকে সূত্র ধরে রিপোর্ট করা শুরু করলো তখন আরো দ্রুত বেগে খবর ছড়াতে থাকে। দেশি-বিদেশি কোন ধরণের গণমাধ্যমই বাদ পড়েনি। তবে সবচেয়ে বেশি “উচ্ছ্বাস” দেখা যায় কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমে। ছোট-বড় সবাই খবরটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেন। এমনকি ভারতের একটি টেলিভিশন চ্যানেল খবরটি নিয়ে একটি টক-শোও করে ফেলে। গণমাধ্যমের এই ভূমিকা নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে।
The urgency with which everyone latched onto the fake Babar Azam story is so disappointing for our profession. Speed might be of the essence but the truth must come first, no?
— Harsha Bhogle (@bhogleharsha) January 18, 2023
‘পাগলা ঘোড়া’র মতো ছুটে চলা এই খবরের রাশ টেনে ধরেন ‘ড. নিমো যাদব’ নিজেই। নিজের টুইটটি সরিয়ে নেন এবং ফক্স ক্রিকেট বাবর আজমের খবরটি প্রকাশ করে যে টুইট করে সেখানে একটি রিপ্লাই করে বলেন, “এই টুইটটি সরিয়ে নাও। চ্যাটিং এর গল্পটি ভুয়া। আমি ব্যাঙ্গাত্নকভাবে এটা করেছি।” এরপর ফক্স ক্রিকেট খবরটি সরিয়ে নেয়। কিন্তু ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম যেমন আজতক, এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমসে তখনও খবরটি ছিলো। তাদের উদ্দেশ্যে নিমো যাদব আরেকটি টুইট করেন এবং সেখানে লেখেন, “ভাই, আমি তো আমার টুইট সরিয়ে নিয়েছি…”
এরপর ঘটনা আরো এগিয়েছে। “নিমো যাদব” বাবরের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, পরবর্তীতে সতর্ক থাকবেনও বলেছেন। কিন্তু সঙ্গে এটিও জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন না যে তার প্রতিটি টুইটে “ডিসক্লেইমার” দেওয়ার দরকার আছে। কারণ তার মতে, তিনি যে ব্যাঙ্গ বা কৌতুক করেন এটা তার ফলোয়ারেরা অনেক আগে থেকেই জানে।
বাবর আজমকে ঘিরে নিমো যাদবের প্যারোডি টুইট কিভাবে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল সে সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য প্রিন্ট, এশিয়া নেট।
ডিসমিসল্যাব পরদিনই ’ড. নিমো যাদব’ নামের অ্যাকাউন্টের পেছনে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে। বার্তালাপ হয় টুইটারে। বাবরের খবরটি কীভাবে তৈরি করলেন তিনি সেটিও জানান। বলেন, “বলিউডের বিখ্যাত শোলে সিনেমা থেকে অনুপ্রানিত হয়েই আমি কাজটা করেছি: এই সিনেমায় ডাকাত গব্বর সিং, নায়িকা বাসন্তীকে বলে যতক্ষণ সে নাচবে ততক্ষণই তার প্রেমিক বেঁচে থাকবে।”
তিনি জানান, টুইটে ব্যবহার করা বাবর আজমের কথিত ছবি ও ভিডিওটি নিয়েছিলেন এশা রাজপুত নামের একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে। পরে সেই অ্যাকাউন্টটিই গায়েব হয়ে যায়।
এমন প্যারোডি টুইট দিয়ে এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কমিউনিকেশন দলকেও বিভ্রান্ত করেছেন তিনি। ২০১৯ সালে ভারতের নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রচারণার অংশ হিসেবে ‘ম্যায় ভি চকিদার’ ক্যাম্পেইন চালু করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই প্রচারণার সমর্থনে “নিরব মোদি” অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করা হলে তাকে ট্যাগ করে আরেকটি টুইট করা হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে। যদিও পরে সেটি সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানায় ভারতীয় পত্রিকা দ্য স্টেটসম্যান।
এই ঘটনার পর তার ওপর এত অনলাইন আক্রমণ হয় যে তিনি ভয়ে টুইটার হ্যান্ডেলে ইউজারনেম নিরব মোদি রেখে দিয়ে অ্যাকাউন্টের নামটিকে নিমো যাদবে বদলে ফেলেন।
কিন্তু তিনি নিরব মোদি নামটি টুইটারের জন্য কেন বেছে নিয়েছিলেন? ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিজের জন্মদিনে তিনি একটি প্যারোডি অ্যাকাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেন, সেই সপ্তাহে ভারতের গণমাধ্যম নিরব মোদির অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে সরগরম ছিল। এ কারণেই অ্যাকাউন্টটি এই নামে খোলা বলে তিনি জানান।
এই অ্যাকাউন্টের লোকেশন পাকিস্তানের লাহোর দেয়া থাকলেও বার্তালাপে “ড. নিমো যাদব” জানান, তিনি একজন ভারতীয়, থাকেনও ভারতেই। প্রথমে লোকেশন দেয়া ছিল ভারতের “খড়গপুর”; তবে কিছু পাকিস্তানি ইউজার তাকে ভারতের “দালাল” বলে গালাগাল করলে প্রতিবাদে তিনি টুইটার লোকেশনে লাহোর, পাকিস্তান করে দেন।
নিজের টুইট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক – সবই উপভোগ করেন তিনি। বলেন, “যখন সব মিডিয়ার কেন্দ্রে কেবল আমি, তখন তো ভালই লাগে।” বার্তালাপে নিজের অনুভূতি বোঝাতে নিচের ছবিটিও জুড়ে দেন।

তবে মিডিয়াকে দায়িত্বশীল হবার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নেওয়া চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, “চাঞ্চল্যকর কিছু পেলেই গণমাধ্যমের তা ছাপিয়ে দেয়া উচিত না, যাচাই করে তারপর সেটি প্রকাশ করা তাদের দায়িত্ব; আর যেকোনো মেসেজ বা টুইট তো অন্তত তিনবার যাচাই করা উচিত।”
শেষ প্রশ্ন ছিল, এরকম টুইট করা কি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হলো কিনা? তিনি বলেন, “না, সেটি দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিল না; টুইটটি মুছে দিয়েছি যাতে আরো না ছড়ায়, এখান থেকে মাইলেজ চাইলে সেটি সরাতাম না।”