তামারা ইয়াসমীন তমা
পিরিয়ডের মেডিকেল মিথ যখন ‘স্বাস্থ্য পরামর্শ’ আকারে মূলধারার গণমাধ্যমে
তামারা ইয়াসমীন তমা
বাংলাদেশি সমাজে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও পিরিয়ডের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ট্যাবু থাকায় তা নিয়ে মানুষের মাঝে ভুল ধারণাও বেশি। এমনকি প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোও অনেক সময় যাচাই-বাছাই ছাড়াই এ সংক্রান্ত নানান ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করে থাকে। এমনই একটি ভুল ধারণা হলো পিরিয়ড চলাকালে শসা, নারিকেল কিংবা ঠাণ্ডা পানি খাওয়া উচিত না।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ, এএফপি ফ্যাক্টচেক-সহ বিশ্বের বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে যাচাই করে এই ধারণাটিকে ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণ করেছে। তারপরও তা বারবার ঘুরেফিরে প্রচারিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মূলধারার গণমাধ্যমে।
সময় নিউজ ২০২২ সালের ২৭ মার্চ পিরিয়ড নিয়ে এক প্রতিবেদনে লিখেছে, “এই সময় খাবার তালিকা থেকে বাদ দিন শসা আর নারিকেলকে। গবেষকরা বলছেন এই দুই খাবার পিরিয়ড চলাকালীন খেলে তা জরায়ু মুখে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়”। প্রতিবেদনটিতে সূত্র হিসেবে বোল্ড স্কাই-এর উল্লেখ করা হয়।
লাইফস্টাইল ওয়েবসাইট ‘বোল্ড স্কাই’ ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ, পিরিয়ড চলাকালীন কোন কোন কাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে শসা ও ঠাণ্ডা পানি এড়িয়ে চলা উচিত দাবি করে বলা হয়, এগুলো খেলে জরায়ু প্রাচীরে পিরিয়ডের রক্ত জমতে পারে। সেখান থেকেই একসময় সিস্ট কিংবা ক্যান্সার কোষের জন্ম নেওয়ার শঙ্কা থাকে।
বোল্ডস্কাই-এর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে: “শসা খাওয়া এড়িয়ে চলুন: এই সময়ে শসা আপনার জন্য খারাপ হতে পারে, কারণ শসাতে থাকা উপাদানগুলোর কারণে জরায়ু প্রাচীরে রক্ত জমতে পারে। বরফ ঠাণ্ডা পানি/সোডা পানি এড়িয়ে চলুন: আপনার উচিত হবে (পিরিয়ডের সময়) অবশ্যই এগুলো এড়িয়ে চলা কেননা, এসব খেলে জরায়ু প্রাচীরে তরল (রক্ত) জমতে পারে। এমনকি ৫-১০ বছর পর এখান থেকে সিস্ট বা ক্যান্সার কোষ তৈরি হতে পারে।” তবে এই প্রতিবেদনে নারিকেলের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
বোল্ডস্কাই-এর প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য পরামর্শ হিসেবে উপস্থাপিত এসব দাবির পক্ষে কোনো নির্দিষ্ট গবেষণা বা বিশেষজ্ঞের বরাত দেয়া হয়নি।
২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, একুশে টিভি “পিরিয়ড চলাকালীন এই চারটি কাজ বর্জন করুন” শিরোনামে একটি সংবাদেও একই ধরনের তথ্য উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনে নামহীন গবেষণার বরাতে লেখা হয়েছে:
“পিরিয়ড চলাকালীন ঠাণ্ডা পানি, কোমল পানীয় এবং নারিকেল খাবেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, পিরিয়ড চলাকালীন ঠাণ্ডা পানি পান করার ফলে পিরিয়ডের রক্ত বের না হয়ে জরায়ু প্রাচীরে জমাট বাঁধতে পারে। যা পরবর্তী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে জরায়ু টিউমার বা ক্যান্সারের আকার ধারণ করতে পারে”।
এই প্রতিবেদনে পিরিয়ডের সময় শসা খেলে বন্ধ্যাত্বের শঙ্কা থাকে এমন ভুল তথ্যও উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনটির এক জায়গায় লেখা হয়- “এসময় শসা খাবেন না। কারণ শসার মধ্যে থাকা রস পিরিয়ডের রক্তকে জরায়ু প্রাচীরে আটকে দিতে পারে। যার ফলে আপনার বন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
২০১৯ সালের ১৭ জুলাই ডেইলি বাংলাদেশও একই ধরনের তথ্য উপস্থাপন করে। একুশে টিভি ২০১৮ সালের ২৩ মে “পিরিয়ডের সময় বিরত থাকুন ১০টি কাজ থেকে” শীর্ষক প্রতিবেদনে বোল্ড স্কাইকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে পিরিয়ডের সময় শসা খাওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করে।
দৈনিক যুগান্তরও ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে লিখেছে, পিরিয়ডের সময় শসা খেলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুসারে, ঠাণ্ডা পানির সঙ্গে ঋতুচক্রের কোনো সম্পর্ক নেই। ঠাণ্ডা পানি খেলে কিংবা কোনো নির্দিষ্ট খাবার খেলে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়া বা পিরিয়ডের রক্ত জমাট বাধার বিষয়কেও তারা মিথ হিসেবে উল্লেখ করে।
এএফপি ফ্যাক্টচেক ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর এক প্রতিবেদনে একাধিক গবেষণা এবং চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের বরাতে পিরিয়ডের সময় শসা, নারকেল কিংবা ঠাণ্ডা পানি খাওয়ার সঙ্গে ‘জরায়ু ক্যান্সার’ বা ‘বন্ধ্যাত্ব’-র সম্পৃক্ততা নেই বলে তুলে ধরে।
নারিকেল ও ঠাণ্ডা পানি পান সম্পর্কে গাইনি বিশেষজ্ঞ আনাইস রেয়েস নাভারো বলেন, “এগুলো খাওয়া কিংবা না খাওয়ায় হরমোনের কোনো তারতম্য হয় না। তাছাড়া নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোনো অসুখের সম্ভাবনাও তৈরি করে না”।
প্রজনন বিশেষজ্ঞ কিয়োশি মাকোতেলা নাকাগাকির মতে, “নারকেল খাওয়া বা বরফ ঠাণ্ডা পানি পান করার সঙ্গে বন্ধ্যাত্ব বা ক্যান্সার, কোনো অসুখেরই সম্পৃক্ততা নেই”। এ ধরনের বক্তব্যের পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শসা খাওয়ার সঙ্গে পিরিয়ডের রক্ত জরায়ুতে জমে যাওয়া ও বন্ধ্যাত্বের প্রসঙ্গে রেয়েস নাভারো বলেন, বন্ধ্যাত্বের অনেক রকমের কারণ আছে, তবে শসা খাওয়া অবশ্যই সেগুলোর কোনোটা নয়।
তবে মূলধারার গণমাধ্যম ছাড়াও পিরিয়ড সম্পর্কিত এই মিথগুলো গত কয়েক বছরে বহুবার ফেসবুক পোস্ট হিসেবেও ভাইরাল হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে ফ্যাক্ট ওয়াচ-এর প্রতিবেদনে।
২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরেও বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদে একই ধরনের তথ্য এসেছে।
এএফপির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই ধরনের তথ্য সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের মে মাসে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় লিখিত একটি পোস্ট থেকে ছড়ায়।
ওই পোস্টটিতে বলা হয়েছিল, “পিরিয়ডের সময় বরফ পানি, সোডা পানি ও নারিকেল খাবেন না। গবেষণা প্রমাণ করে পিরিয়ডের সময় বরফ খেলে জরায়ুর প্রাচীরে পিরিয়ডের রক্ত জমে থাকতে পারে। ৫-১০ বছর পর এখান থেকে সিইএসটি এবং ইউটেরাস ক্যান্সার হতে পারে।”ফ্যাক্টচেকিং সাইট আফ্রিকাচেকও ২০১৯ সালের ১৬ মে নাইজেরিয়ার দুজন চিকিৎসকের বক্তব্যের মাধ্যমে এই দাবিগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন প্রমাণিত করে।