প্রাইড ডেভিড

উইকিপিডিয়ার ভালো, মন্দ ও বিচ্ছিরি
This article is more than 1 year old

উইকিপিডিয়ার ভালো, মন্দ ও বিচ্ছিরি

প্রাইড ডেভিড

গত বছর ইংল্যান্ডের রানী ২য় এলিজাবেথ মারা যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উইকিপিডিয়ায় সেই তথ্য হালনাগাদ করে তাঁকে “জীবিত” থেকে “মৃত” লিখে ফেলা হয়। 

এটি সেই অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়া, যেটিকে পেপার, প্রোজেক্ট বা এ ধরনের কাজে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বারবার সতর্ক করেন শিক্ষকেরা। তাঁদের মতে, বিপদটি হলো: যে কেউই যেকোনো উইকিপিডিয়া পেজ সম্পাদনা করতে পারে।   

কিন্তু উইকিপিডিয়ার লাখ লাখ ব্যবহারকারী আছে। তারা নিশ্চয়ই আমাদের সঠিক তথ্য পাওয়া নিশ্চিতের জন্য কাজ করছেন… তাই না? 

চলুন, এই জনপ্রিয় অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়ার গভীরে যাওয়া যাক। 

পটভূমি  

উইকিপিডিয়া ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে ইন্টারনেট ভিত্তিক মুক্ত বিশ্বকোষ হিসেবে। এখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ আছে: বিমান, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, টেইলর সুইফট, টোস্ট স্যান্ডউইচ, এমনকি এখানে Hundeprutterutchebane-র (ডেনমার্কের একটি বিখ্যাত রোলার কোস্টার যা কুকুরের আকৃতিতে তৈরি) সম্পর্কেও তথ্য পাবেন। অদ্ভুত, তাই না?

এটি পরিচালিত হয় মুক্ত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, এটি কাজ করে একটি কমিউনিটির মাধ্যমে, যারা একসঙ্গে মিলে আর্টিকেলগুলো তৈরি করে। প্রায় যে কেউই আর্টিকেল লিখতে ও সম্পাদনা করতে পারে, যেটি ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে, এমনকি মাঝে মাঝে কুৎসিতও হতে পারে। 

গত কয়েক বছরে উইকিপিডিয়া অনেক ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েছে। তবে এসময়ে এটি একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও গড়ে উঠেছে, এবং এখন এটির সত্যিই কিছু উপকারিতা আছে। 

ভালো দিকগুলো 

উইকিপিডিয়ার সবচেয়ে ভালো দিক হলো এর সহজলভ্যতা। যে কোন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য উইকিপিডিয়ায় যাওয়া সবচেয়ে সহজ ও দ্রুত পদ্ধতি। উইকিপিডিয়ার আর্টিকেলগুলোতে থাকা তথ্যের উৎস আলাদা করে নোট সেকশনে লিংক আকারে রাখা হয়। এতে করে আপনি পুরো আর্টিকেলটি পড়তে না চাইলেও চট করে নিচের নোট সেকশনে গিয়ে সংযুক্ত আর্টিকেলটি দেখে নিতে পারবেন।  

উইকিপিডিয়ার আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো এর কন্টেন্ট পলিসি। যেমন:

১। সব ধরনের আর্টিকেল নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে হবে। অর্থাৎ, আর্টিকেলগুলো যুক্তিযুক্ত ও পক্ষপাতমুক্ত হতে হবে।  

২। মূল গবেষণা থেকে সরাসরি কোন তথ্য আর্টিকেলে সংযোজন করা যাবে না। সব তথ্য অবশ্যই বিশ্বস্ত ও এরই মধ্যে প্রকাশ হওয়া সূত্র থেকে নিতে হবে।  

৩। তথ্যগুলো অবশ্যই যাচাইযোগ্য হতে হবে। পাঠক ও সম্পাদক; উভয়েই যেন অবশ্যই দেখে নিতে পারেন যে, তথ্যটি কোনো বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এসেছে কিনা। 

এই পলিসিগুলো পর্যবেক্ষণে রাখে স্বেচ্ছাসেবী অ্যাডমিনিস্ট্রেটররা। শুধু ইংরেজি ভাষার জন্যই আছে এমন প্রায় ১,০০০ এডমিন, যারা আর্টিকেল ও ফাইল ডিলিট করতে পারে, পেজ সংরক্ষণ বা মুছে ফেলতে পারে, ব্যবহারকারীদের ব্লক ও আনব্লক করতে পারে।  

কোন লেখা যদি তথ্যের দিক দিয়ে দুর্বল হয় বা ঠিকমতো উদ্ধৃত না করা হয় তাহলে একজন পেজ এডিটর আর্টিকেলের উপরের দিকে একটি সতর্ক চিহ্ন যোগ করে দেন। অন্যদিকে, আর্টিকেলের তথ্যগুলো যদি বিশ্বাসযোগ্য ও যাচাই করা হয়ে থাকে, তাহলে লেখার উপরে ডান দিকে (+) চিহ্ন সংবলিত একটি সবুজ বৃত্ত দেখতে পাবেন। 

পরিশেষে, চাইলেই যে কেউ যেন আর্টিকেলে সংযোজন ও পরিবর্তন করতে না পারে, সেজন্য উইকিপিডিয়ার একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। একইসঙ্গে আছে ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা – একটি হিস্টরি সেকশন – যেখানে যে কোনো ব্যবহারকারীই দেখে নিতে পারবে একটি আর্টিকেল কতবার সম্পাদনা করা হয়েছে। 

মন্দ দিকগুলো 

আমরা আগেও যেমনটি বলেছি, উইকিপিডিয়ার আর্টিকেল যে কেউ সম্পাদনা করতে পারে, ফলে কখনো কখনো মানুষ এখানে কিছু অপতথ্য বা হাস্যকর তথ্য যুক্ত করে দিতে পারে। যেমন, বিখ্যাত হলিউড তারকা এমা স্টোনের উইকি পেজে একবার সম্পাদনা করে লেখা হয়েছিল যে তিনি, “একজন সুহাসিনী আমেরিকান অভিনেত্রী। ১৯৮৭ সালে, তিনি পরী হিসেবে আকাশ থেকে নেমে এসেছিলেন। ” এই ধরনের পেজ ভ্যান্ডালিজম সাধারণত সহজেই সনাক্ত ও সংশোধন করা হয়। 

পাঠকদের জন্য, উইকিপিডিয়ায় সহজেই প্রবেশ করা যায়, এখানে অনেক আর্টিকেল আছে। কিন্তু এটি সম্পাদকদের জন্য দুরুহ হয়ে উঠতে পারে। সম্পাদনার জন্য তাদের বিশেষ ধরনের মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজের ওপর দখল রাখতে হয়, এবং ফোন বা ট্যাবলেটের মতো মোবাইল ডিভাইস থেকে সম্পাদনার কাজ করাও কঠিন। 

সবশেষে, আর্টিকেলগুলো অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হতেও কিছুটা সময় লাগে। যার অর্থ, মানুষ একই তথ্যের বিভিন্ন রকম সংস্করণ পেতে পারে। এবং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে, তারা হয়তো কখনো সঠিক সংস্করণটিও পাবে না। 

বিচ্ছিরি দিকগুলো

উইকিপিডিয়া অনেক গুজবেরও জায়গা হয়েছে। এখানে থাকছে কিছু উদাহরণ: 

১।  সাংবাদিক জন সিগেন্টথলার আবিষ্কার করেছিলেন যে, তাঁর উইকি পেজে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি ও ইউ এস অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

২। ক্লাইড ম্যাকনাইট সম্পর্কে একটি আর্টিকেলে কেউ একজন লিখেছিল, আমেরিকান এই র‌্যাপার প্যারিস হিল্টন, লিল ওয়েন ও নিকি মিনাজের সঙ্গে কাজ করেছেন। যদিও তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।  

৩। অন্য একটি আর্টিকেলে “ক্রকোডাইল শিয়ারস” নামে একটি মধ্যযুগীয় যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যেটি নাকি নির্যাতনের সময় ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এটিও ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট। 

এমন আরও অনেক গুজবের তালিকা দিয়ে একটি পেজও আছে উইকিপিডিয়ার। এমন কিছু গুজব তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা যায় এবং সরিয়ে ফেলা হয়। অন্য আরও অনেক কিছু সামনে আসতে বছর লেগে যায়।

উইকিপিডিয়া ব্যবহারে কিছু পরামর্শ

  • আর্টিকেলের নিচে থাকা ফুটনোটগুলো পড়ুন। তারপর নিজেকে এই তিনটি প্রশ্ন করুন- তথ্যের নেপথ্যে কে আছে? প্রমাণ কী? অন্যান্য সোর্সে এসম্পর্কে কী বলা হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো সরবরাহ করেছে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ এডুকেশন গ্রুপ।  
  • উইকিপিডিয়ার আর্টিকেলে থাকা তালার আইকনটিতে খেয়াল করুন। প্যাডলক আইকন থাকলে বুঝবেন এই পেজের তথ্য সম্পাদনা করা সম্ভব না। যদিও এই লকগুলো সাময়িক। এগুলো রাখা হয় তথ্য নষ্ট করে ফেলা বা “সম্পাদনার যুদ্ধ” ঠেকানোর জন্য। 
  • আর্টিকেলের পেজের উপরে বিভিন্ন ট্যাগ লক্ষ্য করুন। এগুলোর মাধ্যমে বলা হতে পারে যে, সংশ্লিষ্ট পেজটিতে কোনো সমস্যা আছে কিনা এবং এখানকার তথ্য আরও সম্পাদনা ও যাচাইয়ের প্রয়োজন আছে কিনা।
  • শেষপর্যায়ে, উইকিপিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করুন। কোনো তথ্যপ্রমাণের জন্য দয়া করে এটিকে প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করবেন না। ফুটনোটগুলো খেয়াল করুন। সেখান থেকে সরাসরি মূল বা বিশ্বস্ত সূত্রে চলে যান। 

রেটিং 

অনেকাংশে সঠিক। আমাদের রিভিউ করা গবেষণার ভিত্তিতে, আমরা উইকিপিডিয়াকে “অনেকাংশে সঠিক” বলে রায় দিতে পারি। এটি শতভাগ নির্ভরযোগ্য না হলেও, উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট পলিসি, সম্পাদনার নীতি, দলবদ্ধ কাজ ইত্যাদির ফলে এটি যুক্তিযুক্তভাবে বিশ্বাসযোগ্য ধরা যায়। এটি অন্তত এর প্রতিযোগী, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতোই বিশ্বাসযোগ্য। 


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পয়েন্টার-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে অনুবাদ ও পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল রিফাত।

আরো কিছু লেখা