ডিসমিসল্যাব
ভয়েস ডিপফেক থেকে বাঁচবেন যেভাবে
ডিসমিসল্যাব
সারাদিনের কাজ শেষে সবেমাত্র ঘরে ফিরে রাতের খাবার খেতে বসেছেন আর তখনই বাজতে শুরু করলো ফোন। আরেক প্রান্তে শুনতে পেলেন প্রিয়জনের কণ্ঠ। বাবা-মা, সন্তান কিংবা ছোটবেলার কোনো বন্ধু ফোন করে আপনাকে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করছেন।
ঘটনা কী বুঝতে আপনি তাদের কাছে কিছু জানতে চাইলেন। কিন্তু তাদের উত্তর কেমন যেন উদ্ভট শোনালো। স্পষ্ট কোনো উত্তর মিলল না, নয়তো এমন কিছু শুনলেন, যা তাদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। আবার কখনো উদ্ভটভাবে উত্তর আসতে কিছুটা দেরি হচ্ছে, যেন তারা আস্তেধীরে চিন্তা করছে। কিন্তু তারপরও আপনি নিশ্চিত যে, এটা আপনার প্রিয় মানুষটিরই ফোনকল। এটা তার কণ্ঠস্বর, কলার আইডিতেও নম্বরটি তারই। এমন অদ্ভুত আচরণ আর আতঙ্ক দেখে আপনি দায়িত্ববোধ থেকে তাদের দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টটিতে টাকা পাঠিয়ে দেন।
পরদিন আপনি কল দিয়ে জানতে চাইলেন যে, সব ঠিক আছে কি না। কিন্তু আপনার প্রিয় মানুষটি জানেনই না আপনি কীসের কথা বলছেন। কেননা তিনি আদৌ আপনাকে কখনো ফোনই করেনি- আপনি আসলে প্রযুক্তির পাতা এক ফাঁদে পা দিয়েছেন, যার নাম ভয়েস ডিপফেক। ২০২২ সালে কয়েক হাজার মানুষ এই প্রতারণার শিকার হন।
কম্পিউটার নিরাপত্তা গবেষক হিসেবে আমরা দেখেছি যে ডিপ-লার্নিং অ্যালগরিদম, অডিও এডিটিং, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সিনথেটিক ভয়েজ জেনারেশন প্রযুক্তি দিন দিন যেভাবে যত উন্নত হচ্ছে, তাতে মানুষের কণ্ঠ আরও বিশ্বাসযোগ্যভাবে নকল বা অনুকরণ করা সম্ভব হয়ে উঠছে।
আরও খারাপ বিষয় হলো চ্যাটজিপিটির মতো চ্যাটবটগুলো বাস্তবসম্মত স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে শুরু করেছে। এসব প্রযুক্তির সঙ্গে ভয়েজ জেনারেশন প্রযুক্তির সম্মিলনে ডিপফেক একসময় স্রেফ রেকর্ডেড অডিও থেকে এখন লাইভে এসে জীবন্ত মানুষের মতোই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফোনে কথা বলা চালিয়ে নিতে পারে।
ভয়েস ক্লোনিং
তবে মানসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য ডিপফেক অডিও বা ভিডিও তৈরি করা সহজ নয়। এর জন্য পর্যাপ্ত শৈল্পিক ও কারিগী দক্ষতার প্রয়োজন হয়। একইসঙ্গে শক্তিশালী হার্ডওয়্যার এবং যে কণ্ঠ নকল করা হবে সেই কণ্ঠস্বরের পর্যাপ্ত নমুনাও থাকতে হয়।
অর্থের বিনিময়ে মাঝারি থেকে উচ্চমানের ভয়েজ ক্লোন তৈরি করে দেবে– এমন পরিষেবার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেক ভয়েজ ডিপফেক টুল স্রেফ এক মিনিট বা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের নমুনা থেকেই এমন ভুয়া অডিও তৈরি করতে পারে যা কাউকে বোকা বানানোর জন্য যথেষ্ট। তবে, খুব কাছের মানুষদের বোকা বানাতে হলে অর্থাৎ, একদম অন্য কারও ছদ্মবেশ নিয়ে প্রতারণা করতে চাইলে অবশ্যই বড় আকারের নমুনা প্রয়োজন হয়।
স্ক্যাম ও অপতথ্যের হাত থেকে যেভাবে বাঁচবেন
এসব পরিস্থিতি মাথায় রেখে, রোচেস্টার ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপি, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং অন্যান্য গবেষকেরা মিলে আমরা তৈরি করেছি ডিফেক প্রজেক্ট। এর মাধ্যমে আমরা এসব ডিপফেক ভিডিও ও অডিওগুলো শনাক্ত এবং ক্ষতির সম্ভাবনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এর বাইরেও সরাসরি ও নিত্যদিনকার বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেই এই ডিপফেক ভিডিওগুলো থেকে বাঁচতে পারেন।
ভয়েস ফিশিং বা ‘ভিশিং’ স্ক্যামগুলোর মতো ডিপফেকের মুখোমুখি হতে পারেন ঘরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে দু জায়গাতেই। ২০১৯ সালে, অপরাধীরা একটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কণ্ঠস্বর নকল করে সহযোগী একটি জ্বালানি সংস্থার কাছ থেকে দুই লাখ ৪৩ হাজার ইউএস ডলার হাতিয়ে নেয়। কণ্ঠ নকল করে এক কর্মচারীকে সরবরাহকারীর কাছে তহবিল হস্তান্তরের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০২২ সালে কাছের মানুষদের কণ্ঠস্বর নকল করে প্রতারকেরা অনেক মানুষের কাছ থেকে প্রায় ১১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়।
কী করবেন
অপ্রত্যাশিত কলগুলোর বিষয়ে সতর্ক থাকুন। এমনকি যদি সেসব মানুষদের আপনি খুব ভালো করেও চিনে থাকেন। তার মানে এই না যে, আপনি প্রতিটি ফোনকলের জন্য শিডিউল তৈরি করবেন। কিন্তু ফোনের আগে অন্তত টেক্সট বা মেইলে যোগাযোগ করে নিতে পারেন। এছাড়া কলার আইডির ওপর নির্ভর করবেন না। কারণ এগুলোও নকল করা যায়। যেমন, কেউ যদি আপনার ব্যাংকের প্রতিনিধি সেজে আপনাকে কল দেয়, তাহলে ফোন রেখে ব্যাংকে সরাসরি কল করে জেনে নিন কলটি সঠিক কি না। তার আগে যে নাম্বার থেকে কল এসেছে তা লিখে রাখুন এবং গুগল করে দেখুন।
এছাড়াও, আপনার সামাজিক নিরাপত্তা নম্বর, বাড়ির ঠিকানা, জন্ম তারিখ, ফোন নম্বর, মধ্যবর্তী নাম, এমনকি আপনার বাচ্চা ও পোষা প্রাণীর নামগুলোর মতো আপনাকে শনাক্ত করতে পারার মতো তথ্যগুলো নিয়ে সতর্ক থাকুন। স্ক্যামাররা ব্যাঙ্ক, রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ও অন্যদের কাছে আপনার ছদ্মবেশ নিতে এসব তথ্য ব্যবহার করে আপনাকে দেউলিয়া করে দিতে পারে বা সম্মানহানি করতে পারে।
আরও একটি পরামর্শ: নিজেকে জানুন। বিশেষত নিজের বুদ্ধিমত্তা, মানসিক পক্ষপাত ও দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে জানুন। এটি সাধারণভাবেই একটি ভালো জীবন সংশ্লিষ্ট উপদেশ। এর মাধ্যমে আপনি প্রভাবিত হওয়া থেকে বাঁচতে পারবেন। স্ক্যামাররা সাধারণত আপনার আর্থিক উদ্বেগ, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও অন্যান্য প্রবণতাগুলো দেখে ফাঁদ পাতার চেষ্টা করে।
এই সতর্কতাগুলো ভয়েস ডিপফেক ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে বেশ ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আপনার পক্ষপাত বা অন্য কারো প্রতি আপনার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ডিপফেক তৈরি হতে পারে।
আপনি যদি আপনার কমিউনিটি বা সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এমন কিছু বলতে শোনেন, যা আসলে তাদের বলার কথা না বা সেটি আপনার কোনো খারাপ সন্দেহের পক্ষে যায়– তাহলে তখনই সতর্ক হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
জো আডেতুনজির এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশনে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।