ডিসমিসল্যাব
ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনে ভুয়া তথ্য এবং টিকটক অ্যালগরিদম
ডিসমিসল্যাব
ইন্দোনেশিয়ায় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাধারণ ও প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন। এটিকে সামনে রেখে গবেষক ও নাগরিক সংগঠনগুলোর অবশ্যই এই নির্বাচনে টিকটকের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা উচিৎ।
বিশ্বে টিকটক ব্যবহারকারীদের সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের পাশাপাশি ভুল ও অপতথ্য ছড়ানোতে ভূমিকা আছে টিকটকের।
ফলে ইন্দোনেশিয়ায় জনমতের ওপর প্ল্যাটফর্মটির সম্ভাব্য প্রভাব যাচাই করা জরুরি। এবং জনসাধারণেরও টিকটকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিৎ, যেন প্ল্যাটফর্মটিতে কী প্রচারিত হচ্ছে– সেদিকে নজরদারি আরও বাড়ানো হয়।
টিকটকে জাতিগত ও ধর্মীয় প্রপাগান্ডা
টিকটক খুব অল্প সময়ে ব্যাপক প্রসার ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, বিশেষভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার তরুণদের মধ্যে। যা থেকে বোঝা যায় এটি জনমত গঠন ও আচরনের ক্ষেত্রে কত উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে।
বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা গিয়েছিল ২০২০ সালে ইন্দোনেশিয়ার শ্রম আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে, যখন ইন্দোনেশীয় তরুণেরা রাজনৈতিক বার্তা প্রচার এবং সমাবেশের পক্ষে সমর্থন অর্জনের জন্য অ্যাপটি কার্যকরভাবে ব্যবহার শুরু করেছিল।
ইন্দোনেশিয়ার মতো মিশ্র সংস্কৃতির দেশে, যেখানে বহু জাতিগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে, সেখানে ডিজিটাল পরিসরে এই ধরনের জাতি ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভুল ও অপতথ্য ছড়িয়ে পড়া উদ্বেগজনক।
সাধারণভাবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ভুল ও অপতথ্যসহ জাতিগত বা ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়।
তবে ইন্দোনেশিয়ায় টিকটকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং বাড়তে থাকা প্রভাবের কারণে এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
অন্যান্য প্রথাগত টেক্সট নির্ভর প্ল্যাটফর্মের তুলনায় টিকটকের শর্ট ফর্ম ভিডিও ফরম্যাট ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
টিকটকে ভিডিওর দৈর্ঘ্য সীমাবদ্ধ হওয়ায় সেখানে প্রেক্ষাপট যুক্ত করা বা তথ্য থেকে ফ্যাক্টচেক করা কঠিন। এ কারণে এটি হয়ে উঠেছে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভুয়া ও অপতথ্য ছড়ানোর উর্বর জায়গা।
টিকটক তাদের অ্যালগরিদমও এমনভাবে তৈরি করেছে যে, ব্যবহারকারীরা তাদের আগ্রহের ভিত্তিতে সাজানো কন্টেন্টগুলোই বেশি দেখতে পায়। ফলে ব্যবহারকারীরা ঘুরেফিরে নিজেদের বিশ্বাস ও সমর্থনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কন্টেন্টগুলোই বেশি দেখেন, যা তাদের বিদ্যমান চিন্তাধারাকেই আরও পোক্ত করে।
যথাযথ নজরদারি না থাকলে, টিকটক হয়ে উঠতে পারে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ ও “সাইবার সৈনিকদের” বেড়ে ওঠার জায়গা।
সাইবার সৈনিক হলো একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী যারা সমন্বিতভাবে বিভিন্ন সাইবার কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেক ক্ষেত্রেই যাদের লক্ষ্য থাকে জনমত প্রভাবিত করা, অনলাইন যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটানো বা সাইবার যুদ্ধ পরিচালনা করা।
এসব ক্ষেত্রে, বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ জাতিগত ও ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যেম বিভাজন ও উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে সাইবার আর্মি মোতায়েন করে।
বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল ২০২২ সালে মালয়েশিয়ান নির্বাচনের সময়, যখন ক্ষতিকর নানা ভাষ্য প্ল্যাটফর্মটিতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং সেগুলো মোকাবিলায় টিকটকের হস্তক্ষেপ পর্যাপ্ত ছিল না।
রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও জনমত
আমার প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে জাতিগত ও ধর্মীয় বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা প্রচারিত হতে শুরু করেছে।
এরকম কন্টেন্টের একটি উদাহরণ হলো আসন্ন নির্বাচনের প্রার্থী, জাকার্তার সাবেক গভর্নর আনিস বাসওয়েদানকে লক্ষ্য করে প্রচারিত মানহানিকর ভিডিও।
২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি @logikapolitik নামের অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা ভিডিওটি শুরু হয় উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে, যেখানে বলা হয়, “ব্যাপ্টিজমের মাধ্যমে নাম দেওয়া শুকর খাওয়ার চেয়েও খারাপ”। বক্তা এরপর বলেন, আনিস পূর্বে ইসলামী কট্টরপন্থীদের থেকে সমর্থন পেলেও খ্রিস্টানদের সমর্থন পেতে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে ইয়োহানেস নাম গ্রহণ করেছেন।
এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায় কীভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ টিকটক প্রোপাগান্ডা কাজে লাগিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ভিডিওটি প্ল্যাটফর্মে ছিল।
এবারও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে সাইবার সৈনিকদের ব্যবহার করা হবে বলে অনুমান করা যায়, যেমনটি আগের নির্বাচনগুলোতে করা হয়েছিল।
এই সাইবার সৈনিকেরা প্রায়ই বিভিন্ন বেনামী বা ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। যার ফলে তারা বিভিন্ন বৈষম্যমূলক বার্তা দ্রুত ও ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়।
এই বার্তাগুলো যতটা না জনপ্রিয় তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হিসেবে হাজির হওয়ার কারণে সেগুলো কার্যকরভাবে জনমত প্রভাবিত করতে পারে এবং সামাজিক বিভাজনও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বাস্তব জীবনে পরিণতি
টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে জাতিগত ও ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা বাস্তব জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন, বিভিন্ন জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনের সময়ও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ভুয়া ও অপতথ্য প্রচার থেকে বাস্তবে প্রতিবাদ, সহিংসতা ছড়াতে শুরু করেছিল।
নির্বাচনের সময় বিদ্বেষমূলক বক্তব্যগুলো প্রায়ই ছড়িয়ে থাকে বিরোধীদলীয় প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা দাবি আকারে, যার উদ্দেশ্য থাকে ক্ষোভ ও বৈরিতা উস্কে দেওয়া।
এখান থেকে সৃষ্ট বিক্ষোভগুলো সহিংস রূপ নিয়েছিল এবং বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত ও অনেকে আহত হন।
ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য টিকটকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ভুল তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেন সেগুলো উত্তেজনা ও সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা না রাখতে পারে।
টিকটকের কন্টেন্ট মডারেশন সিস্টেম উন্নত করতে হবে
ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো রোধে টিকটকের কন্টেন্ট মডারেশন সিস্টেম আরও উন্নত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য টিকটককে আরও বৈচিত্রপূর্ণ ডেটাসেট দিয়ে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন তা আরও ভালোভাবে প্রোপাগাণ্ডা শনাক্ত করতে পারে। পাশাপাশি, স্থানীয় ভাষা ও রীতিনীতির বিষয়ে দক্ষ মডারেটর নিয়োগদানের মাধ্যমে বিষয়গুলো সামলাতে হবে।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেক্ষাপটে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও অপতথ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণের জন্য টিকটকের উচিত স্থানীয় বিশেষজ্ঞ, এনজিও ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত করা।
পরিশেষে, টিকটকের উচিত ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদন প্রকাশ এবং ব্যবহারকারী ও অংশীজনদের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে তাদের মডারেশন প্রক্রিয়া, নীতিমালা ও হালনাগাদ সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
বিস্তারিত ও সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার আসন্ন নির্বাচনের সময় নিরাপদ এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক অনলাইন পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে টিকটক।
নুরিয়ান্টি জাল্লির এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশনে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।