ডিসমিসল্যাব
ফেসবুকে ছড়িয়ে থাকা যেসব ভুল তথ্য প্রায়ই থেকে যায় গবেষকদের গোনার বাইরে
ডিসমিসল্যাব
ফেসবুকে কী পরিমাণ ভুল তথ্য আছে? বেশ কিছু গবেষণা বলছে ফেসবুকে ভুয়া তথ্য অপেক্ষাকৃত কম কিংবা সময়ের সঙ্গে কমেছে ভুল তথ্যের সমস্যা।
এই কাজগুলো অবশ্য পুরো বিষয়টির বেশিরভাগ অংশই তুলে ধরতে পারেনি।
আমাদের গবেষক দলের একজন যোগাযোগ গবেষক, একজন গণমাধ্যম ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক গবেষক এবং একজন একটি ডিজিটাল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। সম্মিলিতভাবে আমরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলাম, যেখানে দেখা গেছে অন্যান্য গবেষণাগুলোতে বিপুল পরিমাণ ভুয়া তথ্যের কথা বিবেচনাই করা হয়নি। ফেসবুকে ভুয়া তথ্যের সবচেয়ে বড় উৎস ভুয়া সংবাদের সাইটগুলো নয়, বরং আরও মৌলিক একটি বিষয়: ছবি। এছাড়া ফেসবুকে যেসব ছবি পোস্ট করা হয়, তার একটি বড় অংশই বিভ্রান্তিকর।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের নির্বাচনের আগে ফেসবুকে পোস্ট করা প্রতি চারটি রাজনৈতিক ছবির মধ্যে একটিতে পাওয়া গেছে ভুয়া তথ্য। ব্যাপকভাবে ছড়ানো এসব ভুল তথ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল কিউঅ্যানন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তিকর উক্তি এবং জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনকে নিয়ে ভিত্তিহীন দাবি।
সংখ্যার হিসাবে ভিজ্যুয়াল মিসইনফরমেশন
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছবিভিত্তিক ভুয়া তথ্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের গবেষণাটিই প্রথম কোনো বড় পরিসরের কাজ। ছবি ভিত্তিক পোস্টগুলো গবেষণার ক্ষেত্রে জরুরি কেননা ফেসবুকে এই ধরনের পোস্টই বেশি দেখা যায়, যেটি কিনা সব ধরনের পোস্টের প্রায় ৪০ শতাংশ।
পূর্ববর্তী গবেষণা অনুসারে, ছবি বেশ শক্তিশালী বিষয়। সংবাদে ছবির সংযোজন সে সংক্রান্ত মনোভাব বদলে দিতে পারে এবং ছবিযুক্ত পোস্টগুলো শেয়ার করার হারও বেশি। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে অপতথ্যের প্রচারণার ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন ধরে ছবির ব্যবহার হয়ে আসছে, যেমনটি দেখা গেছে রাশিয়ার ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সির কাজে।
আমরা বড় কিছু করার লক্ষ্যে, ২০২০ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, ২৫ হাজার পেজ ও পাবলিক গ্রুপ থেকে ১৩ মিলিয়নের বেশি ফেসবুকের ছবি সম্বলিত পোস্ট সংগ্রহ করি। ফেসবুকের অডিয়েন্স এতটাই কেন্দ্রীভূত যে, এই পেজ ও গ্রুপগুলোর এনগেজমেন্ট – লাইক, শেয়ার, রিয়্যাকশন – সব রাজনৈতিক ছবিযুক্ত পোস্টের অন্তত ৯৪ শতাংশ। আমরা পাবলিক ফিগারদের চিহ্নিত করার জন্য ফেসিয়াল রিকগনিশনের সাহায্য নিয়েছি এবং পুনরায় পোস্ট করা ছবিগুলো সনাক্ত করেছি। পরবর্তীতে আমরা আমাদের নমুনায় থাকা ছবিগুলোর একটি বড় অংশ শ্রেণীবদ্ধ করেছি। সবচেয়ে বেশি শেয়ার হওয়া ছবিগুলোও এখানে অন্তর্ভূক্ত করেছি।
সামগ্রিকভাবে, আমাদের ফলাফলগুলো একটি বিষন্ন চিত্র তুলে ধরে: আমাদের ডেটায় থাকা ২৩ শতাংশেই ছিল ভুল তথ্য। আগের কাজগুলোর ধারাবাহিকতায়, আমরা দেখেছি যে, দলীয়ভাবে ভুল তথ্য ছড়ানোর অনুপাতে ভারসাম্য নেই। বামপন্থীদের পক্ষে প্রচারিত পোস্টগুলোর মাত্র ৫ শতাংশ পোস্টে ভুল তথ্য মিললেও ডানপন্থীদের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৩৯ শতাংশ।
ফেসবুকে আমরা যে ভুল তথ্যগুলো পাই সেগুলোর পুনরাবৃত্তির হার ছিল ব্যাপক এবং ধরনও ছিল বেশ সহজ। অসংখ্য ছবি বিভ্রান্তিকরভাবে বিকৃত বা সম্পাদিত করা হলেও বিভ্রান্তিকরভাবে প্রচারিত বিভিন্ন মিম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের ভুয়া পোস্টের স্ক্রিনশট কিংবা কোনো বাস্তব ছবি ভুলভাবে উপস্থাপন- ইত্যাদির হারই ছিল বেশি।
উদাহরণস্বরূপ, বারবার একটি ছবি পোস্ট করে “প্রমাণ” দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ফক্স নিউজের সাবেক উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত জেফরি এপস্টেইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। বাস্তবে ছবির ধূসর চুলের মানুষটি এপস্টেইন নন, বরং অভিনেতা জর্জ ক্লুনি।
তবে আমাদের গবেষণা থেকে একটি ভালো খবরও পাওয়া যায়। পূর্ববর্তী কিছু গবেষণায় বলা হয়েছিল যে, সত্যি পোস্টের তুলনায় ভুল তথ্য সম্বলিত পোস্টের এনগেজমেন্ট বেশি থাকে। কিন্তু আমরা এমন কিছু পাইনি। পেজের সাবস্ক্রাইবার ও গ্রুপের আকার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে আমরা ভুল তথ্যের উপস্থিতির সঙ্গে এনগেজমেন্টের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাইনি। ভুল তথ্য প্রচারিত হলেই তা ভাইরাল হবে এমন নিশ্চয়তাও নেই। তবে এর অর্থ এটিও নয় যে ভুল তথ্য সম্বলিত পোস্টের ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
তবে ফেসবুকের ছবি সম্বলিত পোস্টগুলো কিছু দিক দিয়ে এমন ক্ষতিকর, যা সাধারণ ভুল তথ্যের পরিধি ছাড়িয়ে যায়। আমরা এমন অনেক ছবি পেয়েছি যেগুলো ছিল নিপীড়নমূলক, নারী বা বর্ণবিদ্বেষী। প্রায়ই এমন আক্রমণাত্মক পোস্ট করা হয়েছে ন্যান্সি পেলোসি, হিলারি ক্লিনটন, ম্যাক্সিন ওয়াটারস, কমলা হ্যারিস এবং মিশেল ওবামাকে উদ্দেশ্য করে। যেমন, কমলা হ্যারিসের একটি ছবি বহুবার পোস্ট করতে দেখা গেছে, যেখানে তাকে “উঁচুমাপের” কলগার্ল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আরেকটি ছবিতে মিশেল ওবামার ছবি এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে, যেন মনে হয় যে তাঁর পুরুষাঙ্গ আছে।
জ্ঞানের ফাঁকফোকর
ডিজিটাল রাজনৈতিক পরিসরে ভিজ্যুয়াল মিসইনফরমেশনের ভূমিকা বোঝার জন্য এখনও অনেক কাজ করা বাকি আছে। ফেসবুক এখনও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলেও ফেসবুকের সিস্টার প্ল্যাটফর্ম ইনস্টাগ্রামে দিনে এক বিলিয়নেরও বেশি ছবি পোস্ট করা হয়। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী স্ন্যাপচ্যাটে এ সংখ্যা আরও কয়েক বিলিয়ন। ইউটিউবে পোস্টকৃত ভিডিও কিংবা নতুন আসা টিকটকও রাজনৈতিক ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে, যেগুলো সম্পর্কে গবেষকেরা এখনও খুব বেশি জানেন না।
সম্ভবত আমাদের গবেষণার সবচেয়ে উদ্বেগজনক ফলাফলটি হলো এটি সামাজিক মাধ্যমের ভুল তথ্যের ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমাদের সামগ্রিক অজ্ঞতাকে নির্দেশ করে। এই বিষয়ে শত শত গবেষণা প্রকাশিত হলেও গবেষকরা এখন পর্যন্ত ভুল তথ্যের সবচেয়ে বড় উৎসকে চিহ্নিত করতে পারেননি। আরও কী কী বিষয় আমাদের অজানা থেকে যাচ্ছে?
উনকাং ইয়াং, ম্যাথিউ হিন্ডম্যান ও ট্রেভর ডেভিসের এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশন-এ। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।