সোফিয়া অর্টিজ
হ্যাঁ, টিকটকে কিয়ানু রিভসের ভাইরাল অ্যাকাউন্টটি ডিপফেইক
সোফিয়া অর্টিজ
সম্প্রতি টিকটকে ‘ম্যাট্রিক্স’ ও ‘জন উইক’ খ্যাত হলিউড তারকা কিয়ানু রিভসের একটি অ্যাকাউন্ট হয়তো ভাইরাল হতে দেখে থাকবেন। সেখানে কিয়ানুকে অদ্ভুত সব আচরণ করতে দেখা যায়। ভিডিওগুলো লাখ লাখ লাইক ও কমেন্ট পেয়েছে। কিন্তু কিয়ানু কি সত্যিই টিকটকে এসব অদ্ভুত ভাইরাল সব ভিডিও বানাচ্ছেন?
ইন্টারনেটে হাজার হাজার দর্শককে বোকা বানালেও এগুলো আসলে ডিপফেইক ভিডিও, যার সঙ্গে কিয়ানুর দূরতম সম্পর্কও নেই। চলুন দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে আমরা এগুলোর সত্যতা যাচাই করেছি।
ভুয়া কন্টেন্ট
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বর্তমান যুগে যেমন অনেক আশীর্বাদ বয়ে এনেছে, তেমনি কিছু ভীতিকর বাস্তবতাও তৈরি করেছে। যেমন, যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিপফেইক তৈরি করা হচ্ছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক: ডিপফেইক কী এবং তা কীভাবে শনাক্ত করবো?
ডিপফেইক বলতে বুঝায়, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ.আই) এর সহায়তায় সিন্থেটিক মিডিয়া ব্যবহার করে ফেইক কন্টেন্ট (ভুয়া তথ্য) তৈরি করা। ডিপফেইক ভিডিওতে একজনের মুখের উপর চাইলেই অন্য কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখ বসিয়ে দেওয়া যায়। এতে করে মনে হবে ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিটি বাস্তবেই কাজটি করছে, যদিও সেই কন্টেন্টের সঙ্গে সেই ব্যক্তির কোনো সংশ্লিষ্টতাই নেই।
ডিপফেইক ভিডিও তৈরি করা হয় ক্রমাগত শিখতে থাকা অ্যালগরিদমের মাধ্যমে। যেখানে কিয়ানুর মতো ব্যক্তিদের ছবি-ভিডিও যত বেশি যোগ করা হবে, অ্যালগরিদমটি তত নিখুঁতভাবে তার ছবি-ভিডিও তৈরি করতে পারবে। সেলিব্রিটিদের নিয়ে বানানো ডিপফেইক কন্টেন্টগুলো প্রায়ই খুব নির্ভুল মনে হয়, কারণ অ্যালগরিদমকে শেখানোর জন্য তাদের অনেক ছবি-ভিডিও পাওয়া যায়।
কিয়ানু রিভসের এই ডিপফেইক অ্যাকাউন্টটি কেবলই বিনোদনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, যেমন @deeptomcruise নামের এই টিকটক অ্যাকাউন্ট, যেটির আছে তিন মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার। এছাড়াও সম্প্রতি, পণ্য বিক্রির প্রচারণার জন্য ডিপফেইক ভিডিও বানাতে শুরু করেছে বিজ্ঞাপনদাতারা। যেমন, রাশিয়ার এই বিজ্ঞাপনে “ব্রুস উইলিস”-কে দেখা যায় একটি বোমা নিষ্ক্রিয় করতে।
যখন এটি আর বিনোদন থাকে না
তবে, এই প্রযুক্তি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, যখন এটি অপতথ্য ছড়ানোর কারিগরদের হাতে চলে যায়। যেমন, ২০২২ সালের শুরুর দিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একটি ডিপফেইক ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায়, তিনি ইউক্রেনীয় সৈন্যদের রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পন করতে আদেশ দিচ্ছেন। অবশ্যই এমন কিছু কখনোই ঘটেনি। কিন্তু হ্যাকাররা এই ডিপফেইকটি ইউক্রেনের কয়েকটি নিউজ চ্যানেল ও ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
তারপরও, ডিপফেইক প্রযুক্তি ব্যবহারের কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। যেমন:
- বিনোদনের উদ্দেশ্যে ও ব্যক্তিগত ভাব প্রকাশের জন্য
- চলচ্চিত্রে ব্যবহারের জন্য
- এবং মার্কেটিং-এর কাজে। যেমন, ক্রেতারা কোনো সাইটে শপিং করতে গেলে সেখানে থাকা মডেলদের মুখের জায়গায় নিজেদের চেহারা বসিয়ে জামা কাপড় পছন্দ করতে পারেন।
সূত্রসমূহ
ডিপফেইক সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি দিন দিন আরও উন্নত হয়ে উঠছে। ফলে মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো বা হয়রানির উদ্দেশ্যে এটির ব্যবহার মোকাবিলা করতে হলে দর্শক হিসেবে আমাদের আরও সচেতন হয়ে উঠতে হবে।
আমরা আবার কিয়ানু রিভসের ভাইরাল অ্যাকাউন্টের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখানে স্পষ্টতই কিছু বড় জালিয়াতির ইঙ্গিত আছে। প্রথমত, অ্যাকাউন্টটির ইউজার নেম “unreal_Keeanu” এবং বায়ো-তে লেখা আছে “প্যারোডি” কথাটি। যা থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, এটি কিয়ানুর মূল অ্যাকাউন্ট না। তবে তা সত্ত্বেও এটি অনেক মানুষকে বোকা বানাচ্ছে। এখানে শিক্ষনীয় বিষয় হলো: সব সময় বায়ো খেয়াল করবেন। এছাড়াও, আমরা যখন ভিডিওটি বিশ্লেষণ করি, তখন আরও কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়। যেমন কাছ থেকে লক্ষ্য করলে দেখবেন কিয়ানুর চেহারার ত্বক বেশ বিবর্ণ, চুলগুলোও মিলছে না, সাথে অদ্ভুতভাবে ভিডিওর লাইট ইফেক্টসও পরিবর্তন হচ্ছে। এই সব কিছু মিলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এখানে কিছু একটা সমস্যা আছে।
আপনার যদি কোনো কন্টেন্ট দেখে তা ডিপফেইক বলে সন্দেহ হয়, তাহলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিচের করণীয়গুলো অনুসরণ করতে পারেন:
- ভিডিওতে থাকা ব্যক্তির চোখের দিকে লক্ষ্য করুন। চোখের পলক ফেলছে কি ফেলছে না?
- ত্বকের রঙ লক্ষ্য করে দেখুন তা বিবর্ণ কি না? ডিপফেইক কন্টেন্টে ত্বকের রঙ বিবর্ণ থাকে ও লাইট ইফেক্ট পরিবর্তন হতে থাকে।
- লক্ষ্য করার মতো আরও কিছু সূক্ষ্ম বিষয় আছে। যেমন চুল। সাধারণত চুলের নড়াচড়া দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু তা যদি অনেক বেশি স্থির থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এখানে সমস্যা আছে।
- দাঁতের দিকে খেয়াল করুন। সেগুলো কি দেখতে অস্বাভাবিক বা অস্পষ্ট মনে হচ্ছে কিনা।
- কন্টেন্টের ভিতরে থাকা ব্যক্তিটি যদি কোনো চশমা বা কানের দুল পরে থাকে, তাহলে ভালোভাবে খেয়াল করুন যে, সেখানে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায় কিনা।
- আরও খেয়াল করুন ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিটি যা করছে, বাস্তবে তার ব্যক্তিত্বের সাথে তা মিলছে কি না। যদি এমন কিছু দেখা যায়, যা ঐ ব্যক্তি সাধারণত করবেন না, বা বলবেন না, তাহলে কন্টেন্টটি সন্দেহের চোখে দেখুন। তা ডিপফেইক হতে পারে।
আমাদের রেটিং:
এটি মূল অ্যাকাউন্ট না। কিয়ানু রিভস-এর যে অ্যাকাউন্টটি ভাইরাল হয়েছে তা মূলত ডিপফেইক প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা কন্টেন্ট দিয়ে ভরা। যদিও বায়োতে স্পষ্টই বলা আছে যে, এটি কেবলই বিনোদনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এই অ্যাকাউন্টটির কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এই যুগে মনে রাখবেন, অনলাইনে যা চোখে পড়বে তা-ই বিশ্বাস করে ফেলবেন না।
কিয়ানু রিভসের ডিপফেইক টিকটক অ্যাকাউন্ট নিয়ে এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পয়েন্টার-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে অনুবাদ ও পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল রিফাত।