ডিসমিসল্যাব
ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকেরা কি সত্যিই সেসব তত্ত্বে বিশ্বাস করেন নাকি কল্পনায় বাঁচেন?
ডিসমিসল্যাব
ডেমোক্র্যাটরা ছোট বাচ্চাদের হত্যা করে ও রান্না করে খায়। ভ্যাকসিনে শয়তানের ডিএনএ থাকে। কানাডার নতুন রানি এলিয়েন, তাঁর আছে বিশেষ সব ক্ষমতা।
শুনতে হাস্যকর মনে হলেও এগুলো সবই জনপ্রিয় সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কেউ কীভাবে এগুলোতে বিশ্বাস করতে পারে– তা অনেকেই ভেবে পান না।
একজন দার্শনিক হিসেবে আমি গবেষণা করি কল্পনা নিয়ে। আমার মতে, অনলাইনে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের বুঝতে পারার মূল চাবিকাঠি হলো এটি বুঝতে পারা যে, কীভাবে উদ্ভট খেয়াল ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।
বিশ্বাস নাকি খেয়াল?
গবেষণা বলছে, যারা আজগুবি ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর পক্ষ নেন, তাঁরা সবাই সেসব তত্ত্ব পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। একারণে যখন তাদের সেসব তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি দিতে বলা হয়, তখন ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা সেটিকে সত্য দাবি করা থেকে সরে আসেন। বরং বলেন যে, তারা শুধু “কিছু প্রশ্ন তুলছেন” বা তত্ত্বটি সত্যও হতে পারে।
তাহলে, কোনো তথ্য আপনি পুরোপুরি বিশ্বাস না করলে কেন তার পেছনে সময় দেবেন? কেনই বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ইউটিউবে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভিডিও দেখে, ব্লগ আর পোস্ট পড়ে সময় কাটাবেন? এই বিষয়গুলো সহজে ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব যদি আমরা হাইপোথিসিস হিসেবে ধরে নিই যে, ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের অনেকেই স্রেফ কল্পনায় বাঁচার ইচ্ছা থেকে জিনিসগুলো বিশ্বাস করার ভান করছেন।
এই হাইপোথিসিসের পক্ষে কিছু সমর্থন আসে এই তথ্য থেকে যে, একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কত বেশি দর্শক সম্পৃক্ত হবে, তা নির্ভর করে সেটি কত বেশি বিনোদন দিতে পারছে– তার ওপর, তত্ত্বটির পেছনে কী পরিমাণ যুক্তিপ্রমাণ আছে– তার ওপর নয়। অনলাইনে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে গড়ে ওঠা কমিউনিটিগুলো পূর্ণ থাকে “লাইভ-অ্যাকশন রোল প্লেয়ার” দিয়ে, যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে একটি বড় ভান করার খেলা হিসেবে দেখেন।
সহজেই বোঝা যায় যে, কেন এসব উদ্ভট ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মানুষের কল্পনায় নাড়া দেয়। এগুলোতে ভালো গল্প থাকে, একইসঙ্গে থাকে রাজনৈতিক থ্রিলার।
তাছাড়া, এটি কল্পনা করাও বেশ সুখের যে, আপনি বিশেষ কেউ। কারণ আপনি এমন কিছু জানেন যা খুব কম মানুষই জানে (শুধু কল্পনা করুন যে, দারুণ একটি গোপন বিষয় জেনে ফেলতে কেমন লাগে)। অনেক ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক নিজেকে বিশেষ বা অনন্য হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন, ফলে তারা নিজেদের এমন কিছু গোপন জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে কল্পনা করেন, যা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
কল্পনা থেকে বিশ্বাস
অবশ্য সব ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকই যে এক রকম– তা দাবি করা বাড়াবাড়ি হবে।
কিছু মানুষ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নাম করে চরম সব কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করেন। যেমন: তথাকথিত ভিত্তিহীন পিৎজাগেট ষড়যন্ত্র নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি পারিবারিক রেস্টুরেন্টে গুলি চালানো, বা কানাডার কথিত “রানির” নির্দেশে পুলিশকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা। যারা শুধু ভান করে মজা পায়, তারা সাধারণত এই ধরনের গুরুতর কাজ করে না।
বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনা কীভাবে গুলিয়ে যায়– তা বিবেচনায় নিলে আমরা হয়তো আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব যে, কীভাবে মানুষ এ ধরনের ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস করতে পারে।
সাধারণত আমরা যা কল্পনা করতে ভালোবাসি সেসব জিনিস দিয়ে আমাদের বিশ্বাসকে প্রভাবিত হতে দিই না। কিন্তু প্রায়ই এমনটাও হয় যে, আমরা চারপাশের জগত সম্পর্কে নতুন কোনো বিশ্বাস তৈরির জন্য কল্পনার আশ্রয় নিই। যেমন, আপনি কল্পনা করতে পারেন যে আপনার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, বা আপনার বাড়িতে কতগুলো জানালা আছে– তা দেখতে গিয়ে আপনি কল্পনা করতে পারেন যে, বাড়ির ভেতরটা কেমন হবে।
কেননা আমরা যা কিছু কল্পনা করতে থাকি, তা থেকেই আবার আমাদের বিশ্বাসের জন্ম নেয়। ফলে সবসময়ই ঝুঁকি থেকেই যায় যে, কখন না জানি আমাদের কল্পনা বিশ্বাসকেও প্রভাবিত করা শুরু করে।
নানা কারণে, বিশেষভাবে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা এ ধরনের ভুল করে থাকেন।
যেমন, মানুষ যখন কোনো বিষয়ে বিষদভাবে চিন্তাভাবনা করা শুরু করে, তখন কল্পনাকে বাস্তব হিসেবে ধরে নেওয়ার ভুল বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবং একদল মানুষ যখন একসঙ্গে মিলে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করে, তখন তা থেকে জল্পনা কল্পনা আরও পাখা মেলে।
যেহেতু ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো প্রায়ই সমমনা একদল মানুষ একসঙ্গে মিলে উদ্ভাবন করে, তাই আমরা আশা করতে পারি যে তাদের কল্পনাও বিস্তৃত ও বিশদ হয়।
তাছাড়া এই তাত্ত্বিকরা বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার সীমানা নির্ধারণ করতেও ভুলে যান। ধরুন, কোনো অভিনেতা মঞ্চে অভিনয় করছেন বা বাচ্চারা মিছেমিছি একটি চায়ের দাওয়াত আয়োজন করেছে। এসব ক্ষেত্রে, যারা সেখানে অংশ নিচ্ছে, তারা সবাই কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে।
অভিনেতা জানেন যে দর্শকেরা তাকে দেখছে এবং মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তিনি অভিনয় করা বন্ধ করে দেন। ছোট বাচ্চারা দেখতে পারে যে তাদের নিমন্ত্রিত অতিথিরা আসলে পুতুল, এবং তারা তাদের খেলনা চায়ের কাপে কখনোই সত্যিকারের চুমুক দেয় না।
যেখানে কোনো সীমারেখা নেই
অনলাইন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ক্ষেত্রে সাধারণত এই সীমারেখা থাকে না। সামাজিক মাধ্যম মানুষকে প্রতিনিয়ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও অবাক করার মতো কন্টেন্ট লাইক, শেয়ার, কমেন্ট ও রিটুইট করতে প্ররোচিত করে। ফলে এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহারকারীরা সব সময় এই ধরনের আচরণ করতে থাকেন, যেন তারা উদ্ভট সব তত্ত্ব বিশ্বাস করছেন।
আরেকটি বিষয় হলো, মানুষ হয়তো কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সমর্থন দেয় তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ জানান দেওয়ার জন্য। যেটি তাদের ওপর আরও বাড়তি চাপ তৈরি করে এসব তত্ত্বের প্রতি বিশ্বাস জানানোর জন্য। যেন অন্যরা বুঝে না যায় যে, তিনি এটি বিশ্বাসের ভান করছেন। অনলাইনে এই ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কমিউনিটির অন্যান্য সদস্যরাও একই ধরনের চাপের মধ্যে থাকে।
আর এসব কারণেই এই তাত্ত্বিকরা অনেক সময় বিষয়টি ধরতেও পারেন না যে, এটা নিছক এক কাল্পনিক অভিনয়। নিজের কিংবা অন্যদের আচরণ থেকেও তারা বিষয়টি বুঝতে পারেন না। আর একারণেই তারা সহজে গুলিয়ে ফেলেন যে, কোনটি বাস্তব আর কোনটি বিশ্বাসের ভান।
কল্পনাশক্তির সাহায্যে কল্পজগতের অনেক কিছুই উদ্ঘাটন করা যায়। কল্পনা শক্তি বাস্তবতা সম্পর্কেও নতুন জিনিস শেখাতে সাহায্য করে।
কিন্তু যখন আমরা দুটোর মধ্যে ফারাক করতে পারি না, তখন আমরা এই কল্পনাশক্তির মাধ্যমে আমাদের বিশ্বাসকেও প্রভাবিত করার সুযোগ করে দিই। আর ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা এই ভুলটাই করে থাকেন। তাঁরা নিজেদের কল্পনার জগতে এতটাই হারিয়ে যান যে কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যকার সীমা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হন।
ড্যানিয়েল মুনরোর এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশনে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।