ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
সংবাদের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞাপন চিনবেন যেভাবে
This article is more than 1 year old

সংবাদের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞাপন চিনবেন যেভাবে

ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক

বলুন তো, সর্বোচ্চ কতদিন গোসল না করে ছিলেন? টিকটকের এই ভিডিও বলছে, সময়টা যত বেশি হবে, ততই ভালো। ভিডিওটিতে কলের পানিতে গোসল করার “ক্ষতিকর দিক” তুলে ধরা হয়েছে।

ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে, কলের পানিতে গোসল করা বিপজ্জনক। কারণ এতে পানিতে থাকা ক্লোরিন ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। সারা জীবন কলের পানিতে গোসল করার পর এটা দেখে সন্দেহই জাগে।

যেভাবে আমরা ভিডিওটির তথ্য যাচাই করেছি:

সূত্র অনুসন্ধান

এই টিকটকার আসলে মানুষকে “শাওয়ার ফিল্টারের পিছনে অর্থ খরচ” করতে উদ্ধুদ্ধ করছেন। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছেন না– এমন কোনো দাবি অনলাইনে দেখার পর আপনার প্রথম কাজ হবে সেটির উৎস যাচাই করা।

আমি তার প্রোফাইলে গিয়ে এমন আরও অনেক ভিডিও দেখতে পাই, যেখানে নিয়মিত কলের পানি ব্যবহারের সম্ভাব্য ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমি তার লিংকট্রি প্রোফাইলও খুঁজে পাই, যেটি পানির ফিল্টারের প্রমোশনাল সাইটে ভরা। এগুলো দেখে মনে হলো তিনি ক্যানজেন ওয়াটার সিস্টেমসের একজন ডিস্ট্রিবিউটর, যা কিনা একটি বেশি দামের পানির ফিল্টার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান।

যেহেতু তার পুরো প্ল্যাটফর্ম জুড়েই পানির ফিল্টারের প্রমোশন দেখা যাচ্ছে, ফলে এটি স্পষ্ট যে শুধু বিজ্ঞানের খাতিরে তিনি এই কাজ করছেন না।

মূল ভিডিও ক্লিপটি খুঁজে বের করুন

টিকটকটিতে যুক্ত করা সংবাদের ভিডিও ক্লিপ খুঁজতে ইউটিউবে “শাওয়ারিং উইদ ক্লোরিন ডেঞ্জারস” লিখে সার্চ দিই। ক্লিপের ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা “মর্নিং ব্লেন্ড” শব্দ দুটিও আমি কি-ওয়ার্ড হিসেবে যোগ করি। এতে শুরুতেই সামনে চলে আসে মূল ভিডিও ক্লিপটি। দেখা যায়, ক্লিপটি নেওয়া হয়েছে অ্যারিজোনার টাকসনে কেগান-টিভির একটি মর্নিং নিউজ শো থেকে। 

ভিডিওটিতে যিনি কথা বলেছেন, তাঁর নাম ডের্ক চেম্বারলিন। তিনি ওয়াটার ফিল্টার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান এইচটুও কনসেপ্টসের সঙ্গে জড়িত। যেহেতু তিনি কলের পানিতে ক্লোরিনের বিষয়ে কথা বলছেন, এবং তিনি নিজেও এ সংক্রান্ত একটি পণ্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত, ফলে আমরা ধরেই নিতে পারি যে এখানে পক্ষপাত আছে।

কিওয়ার্ড সার্চ

কিন্তু ক্লোরিনযুক্ত পানিতে গোসল করার ক্ষতি নিয়ে চেম্বারলিনের এই দাবির কি সত্যতা আছে? তিনি বলছেন যে, এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ)-র মতে, আমরা ক্লোরিনের নিরাপদ মাত্রার থেকে ৩০০-৬০০ গুণ বেশি মাত্রার পানিতে গোসল করি।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি “ইপিএ শাওয়ার ওয়াটার ক্লোরিন” লিখে সার্চ দিই এবং ইপিএ-র এই গবেষণাটি পাই যেখানে লেখা, “ক্লোরিনযুক্ত পানি দিয়ে গোসল করায় সামান্যই ঝুঁকি আছে, কারণ মনোক্লোরামাইন সহজে বাতাসে মিশে না”। মনোক্লোরামাইন হলো ক্লোরিন ও অ্যামোনিয়ার একটি মিশ্রণ যা ১৯৩০-এর দশক থেকে কলের পানিতে জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়

এটুকু পড়েই আশ্বস্ত হওয়া যেত। কিন্তু আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ইন্টারনেটে আরও কি কি বলা হয়েছে। এখানে আরেকটি পরামর্শ: যে প্ল্যাটফর্মে দাবিটি পেয়েছেন– সেখান থেকে বেরিয়ে আসুন এবং আরও কিছু ট্যাব খুলে দেখুন যে, অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে এসম্পর্কে কী বলা হয়েছে এবং সেগুলো তুলনা করুন। এটাকে আমরা বলি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি পাঠ।

এটি করতে গিয়ে আমি “ক্লোরিনযুক্ত পানি দিয়ে গোসল” লিখে একটি কিওয়ার্ড সার্চ করি। প্রথম যে ১০টি ফলাফল সামনে আসে, সেগুলোও একই ধরনের ফিল্টার জাতীয় পণ্য বিক্রির ওয়েবসাইট বা ব্লগ। এই সাইটগুলো এড়িয়ে যান। একে বলে ক্লিক রিস্ট্রেইন্ট। অন্যভাবে বললে, প্রথমেই যে সাইটগুলো দেখতে পাবেন– শুধু সেগুলোই ক্লিক করবেন না। বরং বিশ্বাসযোগ্য কিছু না পাওয়া পর্যন্ত স্ক্রল করতে থাকুন।

আমি শেষ পর্যন্ত একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র খুঁজে পাই। বাড়িতে ক্লোরিনযুক্ত পানি ব্যবহার নিয়ে মিনেসোটা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি বিস্তারিত নিবন্ধ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কলের পানিতে থাকা ক্লোরিন ত্বকের মাধ্যমে আপনার শরীরে প্রবেশ করে না, বা এর কারণে শ্বাসকষ্টও হয় না। আসলে, সুইমিং পুলের তুলনায় আপনার প্রতিদিনের গোসলের পানিতে অনেক কম ক্লোরিন থাকে।

এখন ক্লোরিনযুক্ত পানির দিকে আরও নজর দেওয়া যাক। আমি সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের এই নিবন্ধটি খুঁজে পাই, যেখানে পানিতে ক্লোরিন দেওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে, “স্বল্প পরিমাণে ক্লোরিনযুক্ত পানি ব্যবহার বা পান করা স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।”

রেটিং

সঠিক নয়। ক্লোরিনযুক্ত পানিতে গোসল করা বিপজ্জনক– এই দাবিটি সত্য নয়। আমরা নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য সংস্থার সূত্র ধরে এই দাবিটি খণ্ডন করছি। এবং সেই টিকটকার ও মর্নিং শো-এ আসা ব্যক্তির বক্তব্যে পক্ষপাত খুঁজে পেয়েছি। 

এর পরে এমন কোনো সন্দেহজনক দাবি শুনে থাকলে, নিজেকে কিছু প্রশ্ন করুন। প্রথমত, এরা কারা? দ্বিতীয়ত, তাদের সম্পৃক্ততা কোথায়? এবং সর্বোপরি, তাদের “দাবিগুলো” কোথায় থেকে আসছে? এভাবে আপনি বের করতে পারবেন যে, কেউ আসলেই আপনাকে সচেতন করার চেষ্টা করছে নাকি কোনো পণ্য কিনতে প্রলুদ্ধ করছে।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পয়েন্টার-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে অনুবাদ ও পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।

আরো কিছু লেখা