ফাতেমা তাবাসুম
ঠাট্টার ছলে ভুয়া খবর: ছদ্মবেশী প্যারোডি অ্যাকাউন্টের ফাঁদ
ফাতেমা তাবাসুম
গত ৫ মার্চ মেটা প্ল্যাটফর্মসে কোনো ত্রুটির কারণে বিকল হয়ে পড়ে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ও থ্রেডসের মতো অ্যাপগুলো। এরই মধ্যে একটি খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে চাউর হয়, যা ছিল অনেকটা এই রকম- “এক্সে (সাবেক টুইটার) আশার কথা শুনিয়েছেন মেটার সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ; তিনি লিখেছেন, চিল, কয়েক মিনিট অপেক্ষা করুন সব ঠিক হয়ে যাবে”। একই ধরনের খবর প্রচার করতে থাকে আরও অসংখ্য মূলধারার গণমাধ্যম (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১)। পরে জানা যায়, এই টুইট জাকারবার্গের ছিল না; এ ছিল আসলে এক প্যারোডি অ্যাকাউন্টের হেঁয়ালি! এই প্রথম নয়, প্যারোডি অ্যাকাউন্ট এমন মাঝেমাঝেই সাধারণ ব্যবহারকারী তো বটেই, গণমাধ্যমকেও বোকা বানাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লু টিকমার্ক বা ভেরিফায়েড চিহ্ন দেখে এক সময় নিশ্চিতভাবে বোঝা যেত যে এটি সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরই অ্যাকাউন্ট। কিন্তু ২০২২ সালের অক্টোবরে টুইটার কিনে নেওয়ার পর অর্থের বিনিময়ে এই ব্লু টিকমার্ক চিহ্নটি পাওয়ার ব্যবস্থা চালু করেন ইলন মাস্ক। তারপর থেকে যে কেউই যেকোনো নামে নিজের এক্স অ্যাকাউন্টটি ভেরিফায়েড করে নিতে পারেন। তবে অবশ্যই শর্তসাপেক্ষে: অন্য কারো নামে একাউন্ট খুললে নামের সঙ্গে ‘প্যারোডি’ জুড়ে দিতে হবে।
তাতে যে খুব একটা কাজ হচ্ছে তা নয়, বরং প্যারোডির ফাঁদে পড়ছে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবহারকারী সবাই। প্যারোডি অ্যাকাউন্টের সূত্রে শুধু বাংলাদেশেই ২০২৩ সালে অন্তত ৯টি (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯) ভুল তথ্য ছড়িয়েছে এবং সেগুলো নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর বেশিরভাগই ছিল ক্রিকেটারদের নিয়ে।
গুরুতর কিছু হেঁয়ালি
প্যারোডি অ্যাকাউন্টের এমন সব প্রতারণার ফাঁদে সবচেয়ে বেশি হেঁয়ালির শিকার হয়েছেন ক্রিকেট ব্যক্তিত্বরা। গত বছর জানুয়ারিতে, “আবারও যৌন কেলেঙ্কারিতে বাবর আজম।”– শীর্ষক একটি খবর মূলধারার গণমাধ্যমে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০)। কিন্তু পরে দেখা যায়, দাবিটি সঠিক নয়। প্রতিটি সংবাদ মূলত ডা. নিমো যাদব নামের এক ব্যক্তির করা টুইটের বরাতে প্রচার করা হয়েছে। ‘পাগলা ঘোড়া’র মতো ছুটে চলা এই খবরের রাশ টেনে ধরেন ‘ড. নিমো যাদব’ নিজেই এবং টুইটটি সরিয়ে নেন। তার ভুয়া টুইটের ভিত্তিতে খবর প্রকাশ করা ফক্স ক্রিকেটের একটি টুইটে রিপ্লাই করে বলেন, “টুইটটি সরিয়ে নাও। চ্যাটিং এর গল্পটি ভুয়া। আমি ব্যাঙ্গাত্নকভাবে এটা করেছি।” আসলে স্যাটায়ার বা ব্যাঙ্গাত্নক টুইট করার জন্যই ছদ্ম নামে এই অ্যাকাউন্টটি করা। অ্যাকাউন্টের বায়োতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে: প্যারোডি অ্যাকাউন্ট, অ্যাথলেট, গবেষক, প্রাক্তন রঞ্জি প্লেয়ার, ফ্যাক্ট-চেকার, আইআইটি কেজিপি। তারপরও তার করা টুইটে বিভ্রান্ত হয়েছেন সাধারণ ইউজার থেকে বাঘা বাঘা সব গণমাধ্যমও।
ভারতীয় মুসলিম ক্রিকেটারের পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় ইসরায়েলের জন্য উৎসর্গ, টুইট করেছেন ভারতের ক্রিকেটার মোহাম্মদ সিরাজ- এমন স্ক্রিনশট (১, ২, ৩, ৪) গতবছর ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। সিরাজের নামে খোলা একটি এক্স অ্যাকাউন্টে এমন টুইট খুঁজেও পাওয়া যায়। কিন্তু অ্যাকাউন্টে যে “ভারতীয় ক্রিকেটার || প্যারোডি” লেখা আছে, অনেকেই তা খেয়াল করেনি। রিউমর স্ক্যানারের রিপোর্ট বলছে, হ্যান্ডেলটির নাম মাঝখানে কিছুদিন ছিল ক্রিকেটার রাশিদ খান-এর নামে। বর্তমানে একই অ্যাকাউন্টের নাম ডগুজি।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ট্রাভিস হেডের বিশ্বকাপ জয় ফিলিস্তিনকে উৎসর্গ করে টুইট– এমন দাবি গত বছর ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায় ওডিআই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন হবার পর। অস্ট্রেলিয় দলের সহ অধিনায়ক ট্রাভিস হেডের নামে খোলা একটি এক্স অ্যাকাউন্টে এমন টুইট খুঁজেও পাওয়া যায়। যে অ্যাকাউন্টটি ছিল মূলত প্যারোডি এক্স অ্যাকাউন্ট– বিবরণী বা বায়োতে তা লেখাও ছিল। হেডের অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট-এ ফিলিস্তিনকে বিশ্বকাপ উৎসর্গ করা বিষয়ক পোস্ট পাওয়া যায়নি।
শচীন কন্যা সারা টেন্ডুলকার এবং ভারতীয় ক্রিকেটার শুভমান গিলের সম্পর্ক ইঙ্গিত করে সারা টেন্ডুলকারের নামে খোলা প্যারোডি অ্যাকাউন্ট থেকে ৪ দফায় ছড়িয়েছিল ভুয়া খবর।
এছাড়া ফরেস্ট ইকো নিউজ নামের একটি প্যারোডি অ্যাকাউন্ট ইউরো চ্যাম্পিয়ান লীগ ২০১৬ চলাকালে ফুটবলের ভুয়া খবরে গণমাধ্যমকে বারবার বোকা বানিয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হিসেবে নিজেকে দাবি করা “ক্রেগ সেন্সবারি” বাজফিড নিউজকে দেয়া টুইটারে (বর্তমান এক্স) ‘ডিরেক্ট মেসেজ’ সাক্ষাৎকারে বলেন: “আমরা মনে করি এটি হাস্যকর যে অন্যান্য মিডিয়া নির্বোধভাবে আমাদের গুজবের ফাঁদে পড়েছে এবং এটি কেবল দেখায় যে মিডিয়া আমাদের দিকে যা কিছু ছড়াচ্ছে তা আমাদের বিশ্বাস করা উচিত নয়।”
প্যারোডির বিশাল দুনিয়া
ইলন মাস্কের এক্স প্যারোডি অ্যাকাউন্টকে স্বীকৃতি দেয় বলে প্লাটফর্মটিতে অসংখ্য তারকা বা খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভেরিফায়েড প্যারোডি অ্যাকাউন্ট দেখা যায়। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের, আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের, আমেরিকার বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের, ধনকুবের বিল গেটসের, ওপেন এআইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যানের, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির, ইংল্যান্ডের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের এবং বর্তমান রাজা চার্লসের।
এক্স-এর মালিক নিজেও এ তালিকা থেকে বাদ যান নি। ধনকুবের ইলন মাস্কের নামেই রয়েছে অসংখ্য ভেরিফায়েড প্যারোডি অ্যাকাউন্ট (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭)। মার্ক জাকারবার্গের আলোচ্য প্যারোডি অ্যাকাউন্ট ছাড়া অন্য আরও ভেরিফায়েড প্যারোডি অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়া যায় এক্সে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামেও এক্সে একটি প্যারোডি অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়া যায়, যার বায়োতে উল্লেখ আছে এটি একটি প্যারোডি অ্যাকাউন্ট এবং ফেক।
ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নিয়েই আগের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টগুলোর ব্লু চেকমার্ক উঠিয়ে নেন; এবং সুযোগটি সার্বজনীন করেন; তবে শর্ত হচ্ছে ব্যবহারকারীরাকে ভেরিফিকেশন মার্কের জন্য মাসে আট ইউএস ডলার বা ৮৪ ইউএস ডলার বার্ষিক ফি দিতে হবে। সুযোগটি নেয় অনেক প্যারোডি অ্যাকাউন্ট। এক্স দাবি করে তারা এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে, যা কিনা অ্যাকাউন্টের নাম ও বিবৃতি বা বায়োতে “ফেক” বা “প্যারোডি” উল্লেখ করে দেওয়া। কিন্তু একের পর এক প্যারোডির অ্যাকাউন্টের ফাঁদে পড়ার ঘটনা থেকে বলা যায়, এক্স এর শর্ত তেমন ফায়দা দিচ্ছে না।
এএফপি ফ্যাক্টচেক বাংলাদেশের সম্পাদক কদরুদ্দীন শিশির মনে করেন, প্যারোডি অ্যাকাউন্ট সাধারণত খোলা হয় নিছক মজা বা বিনোদনের জন্য, তবে ব্যবসায়িক লাভ বা মানুষকে বিভ্রান্ত করে কারো ব্যাপারে ভুল ধারণা তৈরি করার উদ্দেশ্যেও এর ব্যবহার দেখা গেছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভুয়া তথ্য ছড়ানোর কাজে রাজনীতিকদের প্যারোডি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে সমর্থকেরা পছন্দের রাজনীতিবিদের প্যারোডি অ্যাকাউন্ট খোলেন। অনেক ক্ষেত্রে অপছন্দের দল বা রাজনীতিকদের নামে অ্যাকাউন্ট/পেইজ খুলে এমন কন্টেন্ট পোস্ট করা হয় যাতে ওই রাজনীতিক বা দলের বদনাম হয়। কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে প্যারোডি পেইজ/অ্যাকাউন্ট খুলে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো হয়।”
চেনার উপায়
আফ্রিকার দেশ ঘানায় রাজনীতিবিদদের প্যারোডি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায়ই অপতথ্য ছড়ায়। দেশটির একটি ফ্যাক্ট-চেক প্রকল্প “ফ্যাক্ট-চেক ঘানা” এবং নাইজেরিয়ার গণমাধ্যম ডেইলি ট্রাস্ট পৃথক নিবন্ধে প্যারোডি অ্যাকাউন্ট চিহ্নিতকরণের কিছু উপায় বাতলেছে। সংক্ষেপে কৌশলগুলো হচ্ছে:
১) “প্যারোডি” অ্যাকাউন্ট হলে এক্স অ্যাকাউন্টের হ্যান্ডেল, বা নামের পাশে, বা বন্ধনী ব্যবহার করে, বা হ্যান্ডেলের নীচেই বায়োতে তা অবশ্যই বলা থাকবে। “ভেরিফায়েড” ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইলের হ্যান্ডেল পরিবর্তন করতে পারবেন না (@এর পরের অংশ), তবে প্রোফাইলের নাম পরিবর্তন করতে পারবে।
২) ফলোয়ারের সংখ্যা সাধারণত কম থাকবে। যেমন বিল গেটসের একটি প্যারোডি অ্যাকাউন্ট @বিলগেটস২৮১০। অ্যাকাউন্ট থেকে ফলো করা হচ্ছে মাত্র তিনজনকে। অ্যাকাউন্টিকে ফলোও করছেন মাত্র ৪ জন। যদিও আসল বিল গেটস-এর এক্স অ্যাকাউন্টের ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ৬৪ দশমিক ২ মিলিয়ন। তিনি ফলো করছেন আবার ৫৮৮ জনকে। গণমাধ্যম বা সেলিব্রিটির অনুসরণকারী শূন্য, হাতেগোণা বা খুব কম হলেই সন্দেহ করতে হবে।
৩) বায়োতে দেয়া সংক্ষিপ্ত পরিচিতি খেয়াল করুন। বিখ্যাত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হলে সাধারণত সংক্ষিপ্ত এবং নিজেদের অন্যান্য পরিচয়, সোশ্যাল মিডিয়ার লিংক সেখানে থাকে।
৪) টুইটস খেয়াল করুন। বানান বা ব্যাকরণগত ত্রুটি নেই তো? ঘন ঘন টুইট করা হচ্ছে, বা একই জিনিস বারবার পোস্ট করা হচ্ছে? তাহলে প্যারোডি বা ফেইক বা ফ্যান অ্যাকাউন্ট হবার সম্ভাবনা বেশি। আরো একটি জিনিস প্যারোডি অ্যাকাউন্টগুলোকে আলাদা করে তা হল তারা প্রায়শই মজার এবং ব্যঙ্গাত্মক কিছু পোস্ট করে। তাই সন্দেহ হলেই মূল অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করে ক্রস-চেক করা নিরাপদ।
৫) খেয়াল করুন কেমন ছবি শেয়ার করা হচ্ছে। মিলিয়ে দেখুন কখন ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে। প্যারোডি অ্যাকাউন্টে সাধারণত অন্য কোনো উৎস থেকে সংগ্রহকৃত ছবি ব্যবহার করা হয়। পোস্টও করে থাকে আসল অ্যাকাউন্টের পরে- হোক সেটা এক মিনিট বা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে।
৬) এক্স-এর ভেরিফিকেশন ব্যাজগুলো চিনে রাখুন। ব্লু ভেরিফিকেশন ব্যাজ ছাড়াও, টুইটার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টকে আলাদা করতে নতুন যাচাইকরণ ব্যাজ এবং প্রতীককের ব্যবহার প্রয়োগ করছে।
- সোনালী চেক চিহ্নটি টুইটার দ্বারা যাচাই করা অফিসিয়াল ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টগুলোকে নির্দেশ করে।
- ধূসর চেক চিহ্ন দেখায় যে একটি অ্যাকাউন্ট একটি সরকারী বা বহুপাক্ষিক সংস্থা এবং একটি সরকারী বা বহুপাক্ষিক কর্মকর্তার অন্তর্গত।
- এছাড়াও আছে “অটোমেটেড লেবেল” বা স্বয়ংক্রিয় অ্যাকাউন্ট। সাধারণত কোনো অ্যাকাউন্ট বট বা কোনো এআই দ্বারা পরিচালিত হলে তা সনাক্ত করতে সাহায্য করতে এক্স তাতে স্বয়ংক্রিয় লেবেল প্রদর্শন করে।
শিশির বলেন, সবচেয়ে বড় সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে ছোট খাটো অনলাইন সকলেই কমবেশি প্যারোডির ফাঁদে পড়ছে। তার মতে “এই প্রবণতার মূল কারণ যথেষ্ট ডিজিটাল সাক্ষরতা না থাকা এবং সবার আগে ‘হট‘ নিউজ জানানোর প্রতিযোগিতা, দুটোই।”