ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
‘মৃত ইন্টারনেট তত্ত্বে’ এআই আগ্রাসনের ভয়াল চিত্র, বাস্তবতা বেশি ভয়ঙ্কর

‘মৃত ইন্টারনেট তত্ত্বে’ এআই আগ্রাসনের ভয়াল চিত্র, বাস্তবতা বেশি ভয়ঙ্কর

ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক

ফেসবুকে ইংরেজিতে ‘শ্রিম্প জেসাস’ (‘চিংড়ি যিশু’) লিখে খোঁজ করলেই দেখা যাবে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যিশুর সেই চিরচেনা মুখ ও চিংড়ি মাছের মিশেলে তৈরি অসংখ্য ছবি; যা বানানো হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-এর সাহায্যে, মুখাবয়ব বিকৃত করে, জোড়া লাগিয়ে।

অতি-কাল্পনিক এসব ছবির কোনো কোনোটিতে ২০ হাজারেরও বেশি লাইক-কমেন্ট চোখে পড়বে। আসল ঘটনাটি কী?

এর উত্তর আছে ‘ডেড ইন্টারনেট থিওরির’ কাছে। এই তত্ত্বমতে ইন্টারনেট জগতে এখন ‘এআই’ আর ‘বট’ দিয়ে তৈরি কনটেন্ট এর আধিপত্য এতো বেশি যে তা অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে মানুষের তৈরি কনটেন্টকেও। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধারণার উৎপত্তি কোথায়? বাস্তবেই কি এর কোনো ভিত্তি আছে?

ডেড বা মৃত ইন্টারনেট তত্ত্ব কী?

“মৃত ইন্টারনেট তত্ত্ব” বলে যে, সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের অনেক কর্মকাণ্ড বা কনটেন্ট প্রধানত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এজেন্টদের দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি। এই এজেন্টরা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটক-এর মতো প্ল্যাটফর্মে জনসংযোগ তথা ক্লিক, লাইক, মন্তব্য প্রভৃতি বাড়াতে এআই দিয়ে ছবি তৈরি যেমন করতে পারে, সক্ষম দ্রুত পোস্ট তৈরি করতেও। ‘চিংড়ি যিশু’ ছবির ক্ষেত্রেও মনে হবে যে, ধর্মীয় আইকনগ্রাফির সঙ্গে অবাস্তবতাকে জুড়ে দিয়ে ভাইরাল হওয়ার একটি নতুন কৌশল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা রপ্ত করে ফেলেছে।

তবে ‘মৃত ইন্টারনেট তত্ত্ব’র পরিধি আদতে আরও বড়। এসব কনটেন্টে যেসব অ্যাকাউন্ট লাইক বা কমেন্ট করে সেই অ্যাকাউন্টগুলোও আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এজেন্টদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এইভাবে কৃত্রিম জনসংযোগ বা এনগেজমেন্ট বৃদ্ধির এমন এক দুষ্টচক্র তৈরি হয়, যার সুস্পষ্ট কোনো এজেন্ডা নেই এবং কোনো মানুষও এর সঙ্গে জড়িত নয়।

নিরীহ জনসংযোগ বৃদ্ধি, নাকি অপপ্রচার ছড়ানোর সুচতুর কৌশল?

সাদা চোখে মনে হতে পারে, প্রচুর জনসংযোগ ঘটে এমন অ্যাকাউন্ট থাকলে তা দিয়ে মেটা-র মতো সামাজিক মাধ্যমের বিজ্ঞাপন থেকে আয় সম্ভব; আর এ জন্যই ‘বট’ অ্যাকাউন্ট চালানো হচ্ছে। 

তাহলে কি ‘মৃত ইন্টারনেট তত্ত্ব’র কাজ নিছক এনগেজমেন্ট বাড়ানোর মতো নিরীহ জনসংযোগ বৃদ্ধি? নাকি এর গভীরে রয়েছে মোটা অর্থ ব্যয়ে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাগুলোর পক্ষে সূক্ষ্মভাবে সমর্থন বাড়ানো, বিরোধীদের আক্রমণ করা ও অপপ্রচার ছড়ানোর প্রচেষ্টা?

‘চিংড়ি-যিশু’ ছবির মতো কনটেন্ট তৈরির প্রবণতাটিকে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ ( এবং অদ্ভুতও) মনে হতে পারে; তবে সম্ভবত এগুলো করা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী কোনো নীল নকশার অংশ হিসেবে।

এআই চালিত অ্যাকাউন্টগুলোর যখন ফলোয়ার বাড়ে (অনেকেই ফেক, কিছু আসল), তখন সেই ফলোয়ার দেখে আসল ব্যবহারকারীরাও অ্যাকাউন্টগুলোকে সত্যি বলে গ্রহণ করতে শুরু করে। তার অর্থ হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এধরনের অ্যাকাউন্টের বিশাল বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে। এই বাহিনীতে ফলোয়ারের সংখ্যা যত বেশি হবে, মোতায়েন করে আসবে ততো বেশি সাফল্য।

বিষয়টি খুবই গুরুতর। কারণ বিশ্বের অনেক ব্যবহারকারীর জন্যই সামাজিক মাধ্যম এখন সংবাদ লাভের প্রাথমিক উৎস। অস্ট্রেলিয়ায় গত বছর ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ ব্যবহারকারী সামাজিক মাধ্যমকে তাদের সংবাদ প্রাপ্তির প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই হার ২০২২ সালেও ছিল ২৮ শতাংশ। রেডিও-টিভির মতো প্রচলিত গণমা্ধ্যমগুলোর জায়গা দখল করে নিচ্ছে সামাজিক মাধ্যম।

বট-বিস্তৃত অপতথ্য

ইতোমধ্যেই জোরালো প্রমাণ মিলেছে যে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন বট অ্যাকাউন্ট দিয়ে তথ্য বিকৃত করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং বেশ কয়েক বছর ধরেই এমনটা চলছে।

২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালের ১০ মাসের ১৪ মিলিয়ন টুইট বিশ্লেষণ করা হয়। ফল আসে যে, বট একাউন্টগুলো অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রকাশিত নিবন্ধ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে বড় ভূমিকা রেখেছে। সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, অধিক ফলোয়ারধারী অ্যাকাউন্টস থেকে বিভিন্ন ভুয়া ও অপতথ্য ছড়িয়েছে এবং বটের পোস্ট করা এই কনটেন্টগুলোকে আস্থায় নিয়ে প্রকৃত ব্যবহারকারীরা শেয়ার ও কমেন্ট করেছে।

এই কৌশলে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারীর গণগুলির এক ঘটনার পর। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায় এক্সে (পূর্ববর্তী টুইটার) বটচালিত পোস্টগুলো গণবিতর্ক গড়ে তোলায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। যা থেকে স্পষ্ট হয় যে, এই ধরনের সহিংসতার পর ঘটনার ন্যারেটিভ বা বয়ানকে অতিরঞ্জিত বা বিকৃত করতেও ভূমিকা রাখে এসব বট-পোস্ট । 

অতি সম্প্রতি, অপতথ্য প্রচারে লিপ্ত বেশ কয়েকটি রুশপন্থী বড় চক্র ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দুর্বল করা এবং রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতি বাড়ানোর চেষ্টা চালায়। একটিভিস্ট ও সাংবাদিকরা পরে এটি উন্মোচন করেন যে, বট এবং এআই সংঘবদ্ধ তৎপরতার মাধ্যমে এসব ভুয়া তথ্য তৈরি করেছে এবং লাখ লাখ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর মধ্যে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে।

এই অপপ্রচার ছড়ানোর কাজে কেবল এক্সেই (সাবেক টুইটার) ১০ হাজারেরও বেশি বেশি বট অ্যাকাউন্ট যুক্ত করা হয়, যাদের লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার চলমান যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের তারকারা দৃশ্যত সমর্থন করছেন এমন কয়েক হাজার বার্তা দ্রুত পোস্ট করা।

এই অপপ্রচারটি ছিল বিশাল। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের সমস্ত ইন্টারনেট ট্র্যাফিকের প্রায় অর্ধেক ছিল বট দিয়ে তৈরি। জেনারেটিভ এআই-এর সুবাদে ওপেন এআই -এর চ্যাটজিপিটির বিভিন্ন মডেল এবং গুগল-এর জেমিনি সস্প্রতি আরো শক্তিশালী হয়েছে। ফলে ভুয়া কনটেন্ট তৈরির সক্ষমতাও তাদের ক্রমশ বাড়তে থাকে। 

এ পরিস্থিতিতে সামাজিক মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার রোধের চেষ্টা করছে। যেমন, ইলন মাস্ক বট অ্যাকাউন্ট ঠেকাতে এক্স ব্যবহারকারীদের মধ্যে অর্থের বিনিময়ে মেম্বারশিপ ব্যবস্থা চালু করেছেন।

সামাজিক মাধ্যম জায়ান্টদের বিপুল সংখ্যক চিহ্নিত এই বটগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করার সক্ষমতা আছে, কিন্তু যদি তারা তা চায়। (আমাদের নিরীহ চিংড়ি যিশু কনটেন্ট তৈরিকারকদের জন্য এটি দুঃসংবাদ)।

ডেড ইন্টারনেটের কথা মাথায় রাখুন 

ডেড ইন্টারনেট থিওরি কিন্তু বলছে না যে, ইন্টারনেট জগতে আপনি যতোকিছুর সংস্পর্শে আসছেন তার বেশিরভাগই মিথ্যা। 

বরং এটা এমন এক মজার আয়না- যা দিয়ে ইন্টারনেটকে অন্যভাবে দেখা যেতে পারে। ইন্টারনেট এখন আর শুধু মানুষের জন্য এবং মানুষের তৈরি করা জগৎ নয়; যে অর্থে আমরা এককালে ইন্টারনেটকে চিনতাম-জানতাম, ভালোবাসতাম, তা ‘মরে গেছে’।

আমরা আমাদের ভাবনাগুলোকে ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করার স্বাধীনতা ভোগ করছি- এই স্বাধীনতাই একে এতো শক্তিশালী করে তুলেছে। আর এই শক্তিটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে দুষ্টচক্রগুলো।

ডেড ইন্টারনেট তত্ত্ব আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আমাদের সন্দেহপ্রবণ হতে হবে, সামাজিক মাধ্যম ও অন্যান্য সাইট ব্যবহার করতে হবে ক্রিটিকাল তথা সুক্ষ্ম মন দিয়ে।

হতেই পারে, আপনার একটি মিথষ্ক্রিয়া বা যোগাযোগ, চলমান একটি ট্রেন্ড এবং বিশেষত সামাজিক মাধ্যমে সৃষ্ট একটি আবেগ আসলে ‘সিনথেটিক’, ফাঁপা । আপনি যে চোখে পৃথিবীকে দেখে থাকেন এটাকে সামান্য বদলে দিতে এগুলো বানানো হয়েছে।


এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশন-এ। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।

আরো কিছু লেখা