কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা ও ডিসমিসল্যাবের কর্মীদল

মাহিয়া মাহিকে নিয়ে নির্বাচনী ভিডিওতে ‘বেপর্দা’ হলো সমাজেরই মুখ
This article is more than 9 months old

সামাজিক মাধ্যম

মাহিয়া মাহিকে নিয়ে নির্বাচনী ভিডিওতে ‘বেপর্দা’ হলো সমাজেরই মুখ

কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা ও ডিসমিসল্যাবের কর্মীদল

ফেসবুকে কয়েক সেকেন্ডের একটি রিল বা ছোট্ট ভিডিও। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় দুটি মেয়েসহ ছয়টি শিশুকে দেখা যাচ্ছে। সামনের সারির ছেলে তিনটি বয়সে একটু বড়। তবে তারাও দেখতে বড়জোর আট-নয় বছর বয়সী।

মধ্যের জন মাথার ওপর একটি লাল রঙের খেলনা ট্রাক দুই হাতে ধরে স্লোগান তুলছে আর অন্য দুজন তা শেষ করছে।

বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির জন্য ভোট চেয়ে লোকমুখে বাঁধা এ স্লোগান যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ। ট্রাক মাহির নির্বাচনী প্রতীক।

রিলটির শিরোনাম, “নিজেদের কণ্ঠে”। দুটি ছেলের ভঙ্গি আর হাসি চটুল।

কোনো রিল কতজন দেখেছেন এ হিসাব ফেসবুক দেয় না। এই ভিডিওতে ‘লাইক’ পড়েছে ১৩ হাজারের বেশি। মন্তব্য করেছেন ১৪৮ জন দর্শক আর এটা ছড়ানো বা শেয়ার করা হয়েছে ৩৭ বার।

সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিওতে স্লোগানটি এবং ‘ট্রাক’ প্রতীককে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওগুলোতে দেখানো টুকরো ছবি এবং মানুষজনের কথাবার্তা ও অঙ্গভঙ্গি সরাসরি আর স্থূল বা সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে মাহিকে উপস্থাপন করছে যৌনবস্তু হিসেবে।

ফেসবুকে ‘রংপুর বিনোদন’ প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গ্রামের পথে নেচেকুঁদে চলেছেন তরুণ ও প্রবীণ মিলে সাত জন পুরুষ। লেবেল ঘোষণা দিচ্ছে যে এটা নিছক বিনোদনের জন্য।

এ ভিডিওতে স্লোগানটি ছাড়াও মাহিকে হেয় করা যৌন ইঙ্গিতের ছড়াছড়ি। আর তা শুরু হয়েছে সুড়সুড়ি দেওয়া উত্তেজক ক্যাপশন বা পরিচিতি থেকে।

ভিডিওটিতে পছন্দ ও হাসির চিহ্ন পড়েছে ৩৮ হাজার আর এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এটা দেখেছেন ১০ লাখ মানুষ। মন্তব্য করেছেন এক হাজার জনের বেশি দর্শক।

ফেসবুকের আরেকটি ভিডিও দেখেছেন প্রায় নয় লাখ মানুষ। পছন্দ ও হাসির চিহ্ন পড়েছে ৩৩ হাজার আর মন্তব্য পড়েছে প্রায় ৭০০। এটিতে একজন মাওলানার বয়ান থেকে বাছাই করা কিছু অংশ তুলে দেওয়া হয়েছে।

সেখানে তিনি মাহির নির্বাচনে দাঁড়ানো নিয়ে ‘যুবক’দের টিকটক বানানো প্রসঙ্গে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ স্লোগানটি আবৃত্তি করেছেন। মাহির একটি নির্বাচনী প্রচারণাকে তিনি বলেছেন ‘কিয়ামতের আলামত’। মাহিকে বলেছেন ‘বেপর্দা’।

তিনি মাহির পোশাক, মুখসজ্জা বা মেকআপের খরচকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন। বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন মাহির নির্বাচনে যোগ দেওয়া সম্পর্কে। বলেছেন, মাহি সংসদে গেলে বাংলাদেশকে “ধ্বংস করে শেষ করে দেবে”।

একইসঙ্গে তিনি সংসদ সদস্য সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ বেগম সম্পর্কে বিদ্বেষ ও যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় সংসদ সদস্য হতে চাওয়া খেলোয়াড়, গায়ক, নায়ক-নায়িকাদের তির্যক সমালোচনা করেছেন।

সাংবাদিক, গবেষক ও সংবাদ মাধ্যম বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী বলছেন, “রাজনৈতিকভাবে কাউকে শেষ করে দিতে চাইলে তার দুর্বলতম স্থানে আঘাত করতে হয়। মানুষের যৌনতা বা যৌনজীবন তার দুর্বল ক্ষেত্রগুলোর একটি। দুনিয়াজুড়েই এমন আক্রমণ দেখা যায়।”

তবে মাহির ক্ষেত্রে বিষয়টির ভিন্ন ও বড় একটি মাত্রা আছে। ডিসমিসল্যাবকে আফসান বলেন, “মাহি এ দেশের মানুষের সবচেয়ে চেনা ১০ মুখের একটি। তাঁকে রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। মানুষ তাঁকে দেখছে বিনোদনদাত্রী বা বিনোদিনী হিসেবে।”

জেন্ডার ও মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরীন বলছেন, জেন্ডার-রাজনীতি বা নারীকে ছোট করে রাখার বিষয়টি সর্বজনীন। মাহিকে দেখা হচ্ছে নারী হিসেবে তো বটেই, তার ওপর এনটারটেনার (বিনোদনকারী) হিসেবে।

ডিসমিসল্যাবকে তিনি বলেন, “বিনোদনদাত্রী নারীর জন্য শব্দই আছে ‘নটী’। নটী মানে খারাপ। এটা হলো পেশার সেক্সুয়ালাইজেশন (পেশাকে যৌনতা বা যৌন-উত্তেজক মাত্রায় দেখা)।”

এটা সমাজেরই চেহারা

অধ্যাপক গীতিআরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজকে চিহ্নিত করা হয় ক্লাসিক বা চিরায়ত পিতৃতন্ত্র হিসেবে। এ সমাজে নারীবিদ্বেষ (মিসোজিনি) আছে। এটা হচ্ছে নির্বাচনের সময় নারীবিদ্বেষকে ব্যবহার করে প্রার্থীকে ধসিয়ে দেওয়ার উপায়।

মাহিয়া মাহি আসন্ন সংসদ নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সেটা না পেয়ে তিনি রাজশাহী-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

মাহি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের উপনির্বাচনের জন্যও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পাননি।

মাহির রাজনীতিতে যোগদানের চেষ্টা, বিশেষ করে তিনি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমের পরিসরে তাঁকে নিয়ে অসংখ্য ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। 

ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটক ঘেঁটে ‘মাহি’, ‘ভোট’ ও ‘মাঝখানে’ কী-ওয়ার্ড দেওয়া নির্বাচনকেন্দ্রিক ৬০টি ভিডিও বেছে নিয়ে সেগুলোর প্রবণতা বিশ্লেষণ করেছে ডিসমিসল্যাব। প্রতিটি প্লাটফর্মেই আরও অনেক ভিডিও ছিল। কিন্তু বিশ্লেষণের জন্য শুধুমাত্র সার্চ বা অনুসন্ধানের ফলাফলে প্রথম সারিতে থাকা ভিডিওগুলো নেওয়া হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে ফেসবুকে তোলা ভিডিও আছে মোট ৩৯টি। তার ২৩টিই হচ্ছে রিল। ইউটিউবে তোলা ভিডিও আছে ১০টি, আর টিকটকের আছে ১১টি। ইউটিউবের তিনটি ভিডিও টাকাপয়সা আয় করেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অর্থাৎ, যে চ্যানেলগুলোতে এই তিনটি ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে সেগুলো ‘মনিটাইজড’।

বিশ্লেষণের জন্য নির্বাচিত ভিডিওগুলোর বড় অংশটি তথাকথিত বিনোদনমূলক, যার কয়েকটিতে প্রচারণার সুরও রয়েছে বটে। অন্যদিকে মোট ১৫টি ভিডিওর মূল উপাদান বিভিন্ন ওয়াজ বা মাহফিলে দেওয়া মাওলানা বা মুফতিদের বক্তব্য। একটিতে ‘ইসলামি সংগীত’ পরিবেশিত হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি চলেছে ইসলামি সংগীতের ভিডিওটি। এটি ইউটিউবের আয়কারী ভিডিওগুলোর একটি। এটা কিন্তু প্রথম তোলা হয়েছিল ১১ মাস আগে, মাহির উপনির্বাচনে প্রার্থিতা খোঁজার পর্বে। 

এখন ভোটের হাওয়ায় সেটা আবার ভেসে উঠেছে “মাহিয়া মাহিকে নিয়ে ভোটের গান হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা” ক্যাপশন বা পরিচিতি নিয়ে। এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত রঙ্গ-রস-অবমাননা ও যৌন ইঙ্গিতের মিশেল দেওয়া গানটির এই ভিডিও দেখেছেন ১৮ লাখ মানুষ। পছন্দের চিহ্ন পড়েছে ১৯ হাজার। 

টিকটকের ভিডিওগুলোতে কোনটিরই দর্শক (ভিউ) হাজারের কম নয়। একটিতে এই সংখ্যা ৫৩ হাজারে পৌঁছেছে।

মোটাদাগে দেখা

বিশ্লেষণভুক্ত ভিডিওগুলোর ১৫টি বাদে অন্যগুলোতে শিরোনামে, ক্যাপশনে অথবা মুখের কথায় মাহির জন্য ভোট প্রার্থনার যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ স্লোগানটি এসেছে।

ভিডিওগুলোতে মেয়েদের উপস্থিতি আছে, তবে খুবই কম। কয়েকটিতে নেপথ্য থেকে নারীকণ্ঠ শোনা যায়। একটি টিকটিক ভিডিওতে দুইজন মেয়েকে সেই স্লোগানের সঙ্গে নাচতে দেখা গেছে। একাধিক ভিডিওতে মাহি সেজে অভিনয় করেছেন অল্পবয়সী ছেলেরা। একাধিক ভিডিওতে ‘র‌্যাপ’ গানকে ‘রেপ’ উচ্চারণ করা হয়েছে।

প্রায় সবগুলো বিনোদন ও প্রচারণামূলক ভিডিওর মূল উপজীব্য যৌনতা। কয়েকটি বাদে এগুলোতে ছবি, কথা এবং মানুষজনের অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে মাহিকে স্থূল বা সূক্ষ্মভাবে হেয় করা হয়েছে।

ফেসবুকের একটি অপেক্ষাকৃত কম দেখা ভিডিওতে মাহির নির্বাচনী প্রচারণাকে ব্যাঙ্গ করা হয়েছে। এটাতে ক্যারমবোর্ডের ওপর গুটির বদলে কনডম ঘষে স্থূল যৌন ইঙ্গিত করা হয়েছে।

মাহির নির্বাচনী প্রতীক ট্রাককে জনগণের ট্রাক বলা হয়েছে একটি ভিডিওতে। তাঁর শরীরকে ট্রাকের সঙ্গে সরাসরি বা ইঙ্গিতে তুলনা করা হয়েছে— অনেক ভার নিতে পারে এই অর্থে। একটি ভিডিওতে খেলনা ট্রাকের ওপর একজন তরুণ বয়সী ছেলে যৌন মিলনের ভঙ্গি করছে।

মাহির পোশাক (‘শর্ট জামা’) নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে, সিনেমার দৃশ্য থেকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ‘চিত্রনায়িকা’র বদলে তাঁকে ‘ছিদ্রনায়িকা’ বলা হয়েছে।

অধ্যাপক গীতিআরার মতে, এখানে প্রসঙ্গ যদিও নির্বাচন, কাউকে ছোট করা বা তাঁর প্রার্থিতা নাকচ করার জন্য অস্ত্র হচ্ছে তার যৌনজীবন ও ‘চরিত্র’ নিয়ে ‍প্রশ্ন তোলা। এ ক্ষেত্রে ভালো মেয়ে-খারাপ মেয়ে বিভাজন কাজ করে। খারাপ মেয়ে মানে যৌন আচরণের বিচারে খারাপ। মেয়ের ক্ষেত্রে সেটাই চরিত্রের মাপকাঠি।

মাহিকে ফোনে যৌন হয়রানি করেছিলেন সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সামাজিক মাধ্যমে সেই ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়লে মাহি আবারও ভুক্তভোগী হন।

বেশ কয়েকটি ভিডিওতে ডা. মুরাদের ছবি দিয়ে, নাম বলে অথবা ট্রাককে ‘টাক’ বলে সে কথা টেনে আনা হয়েছে, ইঙ্গিত করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে বা ঠারেঠোরে মাহিকেই দোষারোপ করা হয়েছে।

দর্শকের সংখ্যা ও প্রতিক্রিয়ার জায়গা থেকে ধর্মীয় পটভূমিতে উপস্থাপিত ভিডিওগুলো সাধারণভাবে এগিয়ে আছে। যৌন উত্তেজক রগরগে কথা বা ছবি, ইঙ্গিত, শ্লেষ এগুলোরও বড় উপাদান। ধর্মীয় বয়ান বা গানের মধ্যে ডা. মুরাদের প্রসঙ্গ এসেছে।

এই ভিডিওগুলোতে বাড়তি আছে প্রকট নারীবিদ্বেষ এবং নারীর ক্ষেত্র রাজনীতি নয়—এমন বক্তব্য। বয়ানগুলোর রাজনৈতিক মাত্রা আছে। নেতা হওয়া বা সংসদে যাওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা বিচার করতে গিয়ে ধর্মীয় নেতাদের প্রবেশাধিকার না থাকার কথা এসেছে।

মাহিকে কেবল নারী হিসেবে নয়, হেয় করা হয়েছে তাঁর পেশার সূত্রেও। একইভাবে চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদকে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। মাহিকে দেখা হয়েছে বিনোদনদাত্রী তথা বারনারী হিসেবে। তাঁকে ‘চরিত্রহীন’ বলা হয়েছে।

খুব কম দেখা হওয়া একটি ভিডিওতে মাহিকে একজন মুফতি বলছেন ‘দাইয়ুস’, অর্থাৎ যে নারী অন্যকে জাহান্নামের দিকে ডাকে এবং নিজেও যায়। একাধিক ভিডিওতে তীব্র শ্লেষযুক্ত উচ্চারণে ‘নায়িকা’, ‘নর্তকী’, এমনকি ‘বেশ্যা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তাঁর প্রসঙ্গে বা তাঁর সম্পর্কে আলোচনায়।

ডিসমিল্যাবকে গীতিআরা বলেন, “ঘর ছেড়ে নারী বেরোলে, বাইরের জগতে পা ফেললে তাকে খুব সহজে আমরা খারাপ বলি। শব্দগুলোও তেমনই। ঘরনী-গৃহবধূ বনাম বারবনিতা-বারবধূ যেমন। বারবধূ মানেই সে সবার জন্য অ্যাভেইলেবল (সহজলভ্য)।”

ধর্মীয় পটভূমিতে বসানো একাধিক ভিডিওতে মাহির মুখসজ্জা বা মেকআপের খরচকে শ্লেষ করা হয়েছে। একজন মাওলানা নির্বাচনী পোস্টারকে ব্যাখ্যাসহ বলেছেন ‘সুন্দরী পোস্টার’। যুবকেরা পোস্টারে মাহির ছবিকে জড়িয়ে ধরছে—এসব কথা আছে।

চলতি থাকার দৌড় যখন মাত্রা ছাড়ায় 

এই বিশ্লেষণে টিকটক থেকে মাত্র ১১টি ভিডিও নেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিবেদন লেখার সময় প্লাটফর্মটিতে বলতে গেলে প্রতি ঘন্টায় মাহিয়া মাহিকে নিয়ে একই ধরনের যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ স্লোগানসহ নতুন নতুন ভিডিও যোগ হচ্ছিল।

টিকটকের ভিডিওগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো ফরইউ (#ForYou, #fyp) (#ForYourPage) হ্যাশট্যাগের উপস্থিতি। টিকটকের নিজের ভাষায়, ফরইউ হচ্ছে টিকটক ব্যবহারকারীদের ‘অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দু’। এখানেই বেশির ভাগ ব্যবহারকারী সময় কাটান। 

টিকটক বলছে, “আপনি যখন টিকটক খুলে আপনার ফিডে নামবেন, তখন আপনার আগ্রহের ভিত্তিতে তৈরি করা ভিডিওর একটি ধারা (স্ট্রিম) পাবেন। এটা আপনার জন্য পছন্দের আধেয় ও নির্মাতাদের খুঁজে পাওয়ার কাজটি সহজ করে তোলে।”

স্বাভাবিকভাবেই টিকটকের আধেয় নির্মাতারা ফরইউ পাতায় থাকতে চান এবং যখন যে বিষয়টি আলোচনায় আসে সেটি নিয়ে #ফরইউ ভিডিও তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। ফেসবুক এবং ইউটিউবের কিছু ভিডিওতে ফরইউর পাশাপাশি ভাইরাল এবং ভাইরাল ভিডিও হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়।

আফসান চৌধুরীর মতে, সামাজিক মাধ্যমে মানুষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। ডিসমিল্যাবকে তিনি বলেন, “এর জন্য খুব বেশি ভাবনাচিন্তা বা বুদ্ধির চর্চা করতে হয় না। এই প্লাটফর্মগুলো মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলো বেশি আকৃষ্ট করে। যৌনতা যেমন। এই মাধ্যমগুলোর প্রধান চরিত্র বা উপজীব্য হচ্ছে সেনসেশনালিজম (চমক, উত্তেজনা, রগরগে আবেগ)।”

অধ্যাপক গীতিআরা বলছেন, সমাজে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা বরাবরই আছে। সামাজিক মাধ্যম সেটাকে বহুগুণ করতে পারে। ফলে আগে যা ছোট পরিসরে ছিল, এখন তা বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ছে।

ডিসমিল্যাবকে তিনি বলেন, “এটা [নারীকে] বাজারে নিয়ে বিচার-সালিশ করা বা ঢিল মারার মতো। একেকজন এসে পাঁচটা করে ঢিল মেরে যেতে পারে। বহুগুণ জোরালো করা, ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। নিজেকে লুকিয়ে রেখে খারাপ কাজ করার সুযোগ মেলে।”

সামাজিক প্লাটফর্মের নীতিমালা

এই ভিডিওগুলো থেকে যেসব নজির এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, তার অনেকগুলোই ফেসবুক ও ইউটিউবের হেটস্পিচ বা ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক কথাসংক্রান্ত নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। একই কথা খাটবে ‘বুলিং’ বা শাসানিসংক্রান্ত নীতিমালা সম্পর্কে।

জেন্ডারভিত্তিক ক্ষতিকর ছাঁচীকরণ (স্টেরিওটাইপ), ঘৃণা, ছোট করে দেখানো, এক্সক্লুশন (বর্জন করা, প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা) বা সেগ্রিগেশনের (অচ্ছুৎ, বিচ্ছিন্ন, আলাদা বা একঘরে করে রাখা) আহ্বান– সবগুলোই ফেসবুকের নীতিতে বিদ্বেষমূলক কথা

নীতিমালা বলছে, ফেসবুকে এমন কথা বলা যাবে না। ইঙ্গিতে বলাও নিষেধ। তা ছাড়া লেখা বা ছবিতে এমন সাধারণীকরণ থাকতে পারবে না, যা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে (জেন্ডার ভেদে) খাটো করে উপস্থাপন করে। একইভাবে যৌন আচরণসম্পর্কিত অবমাননাকর শব্দ (বেশ্যা, ছিনাল, বিকৃতকামী ইত্যাদি) ব্যবহার করা যাবে না।

ইউটিউবের অশ্লীল বা অশালীন (ভালগার) ভাষাসংক্রান্ত নীতিমালাতেও একই ধারার বিধান আছে। ভাষা বা বিবরণে যৌনতার নগ্ন প্রকাশ, আধেয়তে মাত্রাতিরিক্ত অশ্লীলতা, আধেয়র শিরোনামে, থাম্বনেলে বা সংশ্লিষ্ট মেটা ডাটায় অতি মাত্রায় অশ্লীলতা বা যৌন ইঙ্গিতবহ শব্দ থাকলে ইউটিউব ব্যবস্থা নেবে। আধেয় সরিয়েও ফেলা হতে পারে।

আরও বলা হয়েছে, ইউটিউব লিঙ্গ বা জেন্ডারভিত্তিক কোনো ঘৃণামূলক কথা প্রকাশ করতে দেবে না। ইউটিউবের হয়রানি ও সাইবারবুলিং (অনলাইনে শাসানি) নীতিমালা বলছে, শনাক্তকরণযোগ্য ব্যক্তিকে অনভিপ্রেত যৌন মাত্রায় দেখানো যাবে না। এর মধ্যে পড়ছে কাউকে রগরগে, নোংরা, অশ্লীল, লালসাপূর্ণ অবমাননাকর এবং নগ্নভাবে যৌন মাত্রায় দেখানো।

মাহিয়া মাহিকে নিয়ে এ ধরনের আধেয়র ক্ষেত্রে এসব নীতিমালা কেন প্রযোজ্য হয়নি তা স্পষ্ট নয়।

অধ্যাপক গীতিআরা ডিসমিসল্যাবকে বলেন, “সামাজিক মাধ্যমের নীতিমালা যেমন আছে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং ব্যক্তির তরফ থেকে ‘হিট’ বাড়ানোর ব্যবসায়িক তাগিদ আছে।” তিনি বলছেন, আসলে এমন আধেয়র প্রচার-প্রসার ঠেকাতে হলে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে চেষ্টা শুরু করতে হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান— সব পর্যায়ে ঘৃণা বন্ধ করার দায়িত্ব আছে।

ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ানো কথা বন্ধ হওয়া উচিত, বলছেন আফসান চৌধুরী। তবে তিনি বলেন, “সবাই যেহেতু এই কাজটা করছে, ধরে নিতে হবে কেউই এটা ঠেকানোর বা থামানোর দায়িত্ব নিচ্ছে না। প্রযুক্তিগতভাবে এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো জায়গায় এটা বন্ধ হয় না। ছেলেরাও এর ভুক্তভোগী হয়। তা ছাড়া, নেতিবাচক প্রচারণা অনেক বেশি মানুষকে টানে। মেটা সেটা জানে।”

রাজনীতির জগত, জগতের রাজনীতি

স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর মাহি বলেছিলেন, নৌকা তিনি পাননি তবে তিনিও নৌকার একজন মাঝি

গত ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেন বলে মাহি অভিযোগ করেন পরদিন তিনি অভিযোগ করেন, এলাকার এক গ্রামে তাঁর নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়া হয়েছে

সামাজিক মাধ্যমের দু-একটি ভিডিওতে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু সেখানে মাহির প্রতি বিদ্বেষের ক্ষেত্রটি আরও বড়। সেই বিদ্বেষের শেকড় মূলত সমাজের মধ্যেই। একইসঙ্গে এর পেছনে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বা লাইক কামানোর তাগিদও আছে।

অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন বলছেন, নারী ঘর ছেড়ে বাইরে এলে বিশেষ করে রাজনীতিতে যোগ দিলে সাধারণভাবে সবাই তাকে সরিয়ে দিতে চায়। তিনি বললেন, “এ ক্ষেত্রে প্রচুর মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়। সবার মনের কথা এটা।”

আর আফসান চৌধুরী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা সাহারা খাতুনের মতো ব্যক্তিকে মানুষ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখতে রাজি আছে। মাহিকে নয়। বিদ্বেষের আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে এমন ভাবনা যে তিনি তাঁর জগৎ ছেড়ে অন্য জগতে ভাগ বসাতে এসেছেন।”

ব্যাখ্যা: এ প্রতিবেদনে ভিডিও থেকে উদ্ধৃত ছবি, শব্দ, শব্দবন্ধ, বর্ণনা– কোনো কিছুই এসব আধেয়কে ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়নি। এগুলো দেখানো হয়েছে ক্ষতিকর চর্চার নজির হিসেবে। নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে। তবে এর কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। প্রতিবেদনটি সামাজিক প্রবণতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে মাত্র।

আরো কিছু লেখা