ডিসমিসল্যাব
ইন্টারনেটে ভুয়া তথ্যের ফাঁদ, আত্মরক্ষার উপায়
ডিসমিসল্যাব
ভুয়া তথ্য ও চরমপন্থা যখন বেড়ে চলে, তখন সহজ হচ্ছে এর জন্য কাউকে অভিযুক্ত করা- যেমন ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ব্যক্তিবর্গ, আবেগতাড়িত রাজনৈতিক প্রচারণা, ধর্ম, বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। আর একবার কোনো একটি কারণকে আমরা ঠিক বলে ধরে নেই, সামনে আসে সমাধানও: আরও বেশি ফ্যাক্টচেকিং করতে হবে, বাগে আনতে হবে বিজ্ঞাপন এবং ‘বাড় বেড়েছে’ এমন ইউটিউবারদের শায়েস্তা বা নিষিদ্ধ করতে হবে!
কিন্তু এই কৌশলগুলোই যদি একমাত্র সমাধান হতো, তাহলে ইতোমধ্যেই আমরা দেখতাম যে বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠী কিংবা চরম মতাদর্শের অনুসারী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে, সেইসঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে ইন্টারনেটে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হার। কিন্তু আমরা তো তা দেখছি না।
জার্নাল অফ সোসিওলজিতে প্রকাশিত নতুন গবেষণায়, আমরা এবং আমাদের সহকর্মীরা দেখছি যে, চরমপন্থা এমন এক প্রক্রিয়া, ধাপে ধাপে যার তীব্রতা বেড়ে চলে এবং কিছু সংখ্যক মানুষ এমন একটি ধাপে চলে যায় যে তারা সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
গবেষণায় আমরা দেখছি যে, তথ্য নয়, বরং ভুয়া তথ্য ও চরমপন্থার প্রক্রিয়াটি মানুষের আবেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত; এর সঙ্গে তথ্যের সম্পর্ক নেই।
আর এই বিষয়টি উপলব্ধি করা আমাদের সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
নিয়ন্ত্রণবোধ
সংবাদপত্র এবং অনলাইনে পাওয়া কয়েক ডজন পাবলিক স্টেটমেন্ট তথা উন্মুক্ত বিবৃতি আমরা বিশ্লেষণ করেছি- যেখানে চরমপন্থা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে।
আমরা আরো দেখতে পেয়েছি ভুয়া তথ্যের তীব্রতায় কমবেশি থাকে। একই কথা সত্য সংশ্লিষ্ট অনলাইন গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে, যারা কিনা বারবার একই আচরণ করতে থাকে।
প্রাথমিক পর্যায়ে, আমরা দেখেছি যে, উদ্বিগ্ন করে এমন কোনো বিষয়ের মাধ্যমে মানুষ ভুয়া তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছে, এক্ষেত্রে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোর অ্যালগরিদম, নয়তো বন্ধুরা ভূমিকা রাখছে। আবার ‘খারাপ লেগেছে’ এমন কিছুর ব্যাখা অনুসন্ধান করতে গিয়েও তারা ভুয়া তথ্যের ফাঁদে পড়ছে।
তারা একই ধরনের জিনিস বারবার পাওয়ার কথাও প্রায়শ জানাচ্ছে: যেমন এক ধরনের নিশ্চয়তাবোধ, তারা কথা বলতে পারে এমন নতুন কোনো গোষ্ঠী, সর্বোপরি এমন একটি অনুভূতি পায় যে তারা জীবনের উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে।
চরমপন্থার দিকে যাত্রায় যে প্রক্রিয়াটি আমরা চিহ্নিত করেছি তার মাঝখানে যখন মানুষ পৌঁছে যায়, আমরা তাদের চিহ্নিত করেছি এমন একটি গোষ্ঠী হিসেবে যারা একটি নতুন সম্প্রদায়, এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধে নিজেদের খুইয়ে ফেলে।
বাড়তে থাকা তীব্রতা
আরো তীব্র ধাপে গিয়ে মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো বুঝতে শুরু করে। এর মধ্যে আছে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার-স্বজনদের হারানো, স্ক্রিনে বেশি সময় দিতে গিয়ে ঘুম কম হওয়া ও স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভোগা এবং মানসিক চাপ ও উদ্বেগে ভোগা। এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে তারা ফের বিচ্ছিন্ন দলগুলোর কাছেই ফিরে গিয়েছে।
আমাদের ডেটাসেটের বেশিরভাগ মানুষ এই মাঝের ধাপগুলো অতিক্রম করতে পারেনি। তবে তারা, অব্যাহতভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ভুয়া তথ্যের চক্রটিকে টিকে থাকতে সাহায্য করে গেছে।
যেসব ব্যক্তি আরো এগিয়ে গেছে এবং আমাদের মডেলের চূড়ান্ত ধাপে এসে পৌঁছেছে, তারা সক্রিয়ভাবে ক্ষতিকারক আচরণ করছিল।
এই চরম ধাপে পৌঁছানো ব্যক্তিরা তাদের অভিজ্ঞতার যেসব বর্ণনা দিয়েছে তার মধ্যে আছে প্রিয়জনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, প্রকাশ্যে ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের তৈরি কোনো যুক্তি দেখিয়ে অন্যদের সঙ্গে সহিংস আচরণে লিপ্ত হওয়া।
এই স্তরে একজন পৌঁছে গেলে, তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে কঠোর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে। অতএব মূল চ্যালেঞ্জটি হলো মানুষ যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী এসব দলে যোগ দেওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে, তখনই তাদের কীভাবে আরও নিরাপদ ও কার্যকরভাবে সরিয়ে আনা যায় তা বের করা।
লজ্জা নয়, সহানুভূতির সঙ্গে সাড়া দিন
এ বিষয়ে আমাদের কিছু পরামর্শ রয়েছে। এখনও যারা চরমপন্থার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে তাদের সঙ্গে বন্ধু, ডাক্তার কিংবা নার্সের মতো বিশ্বস্ত পরামর্শদাতারা সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ করলে তা বড় প্রভাব রাখতে পারে।
যদি কেউ লক্ষ্য করেন যে কোনো প্রিয়জন এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাভাবনা পোষণ করছে, যেমন টিকার প্রতি ভয়, কিংবা নারী বা অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতি বিরুপ মনোভাব পোষণ, তাহলে ঠাণ্ডা মাথায় এর পেছনের কারণটি বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। আর এর ফল হবে সুদুরপ্রসারী।
তারা লজ্জা বোধ করতে পারে কিংবা মানসিকভাবে আঘাত পেতে পারে এমন আচরণ করা হলে সেটা হবে সবচেয়ে খারাপ সহায়তা। এর ফলে তারা আবারও ক্ষতিকর সেই গোষ্ঠীতে ফিরে যেতে পারে, যা তাদের চরমপন্থায় ভিড়ে যাওয়াকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
এমনকি ব্যক্তিটির আদর্শ যদি একেবারে চরমপন্থায় চলেও যায়, তার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখাটা তাদের জন্য একটি শেষ আশ্রয় হিসেবে কাজ করতে পারে। আগে হোক বা পরে, তাদের সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটি রাস্তা অন্তত খোলা থাকলো।
আমরা দেখেছি, এক ব্যক্তি যখন চরমপন্থার দিকে যাত্রাপথের মাঝখানে পৌঁছায় তখন সরকার নয় বরং সাধারণ ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন ‘থার্ড পার্টি কনটেন্ট’ও তাদের কাছে সহজে পৌঁছে যায়। আমাদের গবেষণার নমুনায় আসা অসংখ্য ব্যক্তিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা প্ররোচিত হয়ে চরমপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। এই দিক থেকে আমরা মনে করি যে এসব সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের পেছনে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সমাজে ছড়ানো তাদের স্বয়ংক্রিয় টুলের প্রভাবের জন্য দায়ী করা উচিত।
আমরা আরো দেখেছি, মাঝামাঝি পর্যায় থাকাকালেই মানুষ আর সাধারণ যুক্তি বা বাস্তব তর্কগুলো মানতে চায় না। বন্ধু হোক, কিংবা সংবাদকর্মী এমনকি প্ল্যাটফর্মের ফ্যাক্টচেক টুলের কথাগুলোও তারা আর বিবেচনায় নেয় না।
আমরা দেখেছি যে, সবচেয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে শুধু কঠোর হস্তক্ষেপই কাজে আসে। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা চরমপন্থার অনুসারী স্বজনটিকে কোনো সংশোধনকেন্দ্র কিংবা সরকার চালিত ডিরেডিক্যালাইজেশন প্রোগ্রামে নিয়ে যেতে পারেন।
চরমপন্থা থেকে আত্মরক্ষা
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে একজন চরমপন্থায় জড়িয়ে পড়া থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন?
সমাজ যত বেশি ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে, আমরাও ততো বেশি ভুয়া তথ্যের সম্মুখীন হচ্ছি। অনলাইন ইকো চেম্বার আমাদের পৃথিবীটাকে সম্ভবত আরো ছোট করে দেবে ভবিষ্যতে।
এক্ষেত্রে একটি কৌশল হতে পারে মুদ্রিত বই থেকে দীর্ঘ কোনো লেখা পড়ার অভ্যাস করা। এতে করে সমালোচনাত্মক চিন্তাভাবনা বা ক্রিটিকাল থিংকিং বৃদ্ধি পায়।
আবেগীয় প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করার আরেকটি উপায় হলো ঢালাওভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের অভ্যাসটিতে লাগাম টেনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা ব্যবহার করা।
তৃতীয় উপায়টি হলো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখা এবং আরও বেশি ’অ্যানালগ’ জীবন যাপন করা- যে জীবনের আরও অনেক সুবিধা রয়েছে।
তাই সংক্ষেপে বললে লগ আউট করুন, বই পাঠ করুন এবং আরও বেশি বেশি সময় কাটান প্রিয়জনদের সঙ্গে।
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশন-এ। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।