তামারা ইয়াসমীন তমা
সকালে বা খালি পেটে ফল খেলে কি পুষ্টি বেশি?
তামারা ইয়াসমীন তমা
ফল সাধারণভাবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু কখন, কীভাবে ফল খাবেন এমন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গোটা বিশ্বে অনেক ধরনের মিথ প্রচলিত আছে। বিদেশি ওয়েবসাইটের সূত্র ধরে দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও প্রতিনিয়তই এমন খবর বেরোয়, যা কখনো কখনো এই মিথ বা ভুল ধারণাগুলোকেই প্রতিষ্ঠিত করে।
সম্প্রতি দেশের একাধিক গণমাধ্যমের (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬) প্রতিবেদনে দাবি করা হয় খালি পেটে ফল খেলে পুষ্টি পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। এসব প্রতিবেদনে সকাল বেলা ফল খাওয়াকে সবচেয়ে আদর্শ সময় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একাধিক সাইট ও গবেষণা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফল খালি পেটে খাওয়া হোক কিংবা ভরা পেটে, তাতে পুষ্টির কোনো তারতম্য হয় না। একই সঙ্গে দিনের যেকোনো সময়ই ফল খাওয়া হোক না কেন, একই উপকার মিলবে।
খালি পেটে ফল খেলে কী বেশি পুষ্টি?
গত ৩১ জানুয়ারি, দৈনিক যায় যায় দিন লিখেছে, “সকাল বেলা খালি পেটে স্বাস্থ্যের জন্য সব চাইতে উপকারী যে কাজটি করতে পারেন তা হল একটি ফল খাওয়া। যেহেতু পেট খালি, তাই এই অভ্যাস ফলটির পুষ্টি শরীরে গ্রহণে সহায়তা করবে।” একই দিনে আমাদের সময়-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ বিডিনিউজ২৪ ফল খাওয়ার সঠিক পন্থা শীর্ষক প্রতিবেদনে একই তথ্য দিয়েছে।
মার্কিন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যদাতা সংস্থা হেলথলাইন নিশ্চিত করেছে যে, খালি পেটে ফল খেলে পুষ্টি বেশি মিলবে বলে প্রচলিত ধারণাটি ভুল। এনসিবিআই ডেটাবেজের বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে তারা ফল খাওয়া সংক্রান্ত ভুল ধারণাগুলো খণ্ডন করেছে।
হেলথলাইন লিখেছে, খাদ্য থেকে পুষ্টি গ্রহণে মানবদেহের কার্যক্ষমতা পর্যাপ্ত। প্রথমত, কোনো খাবার খেলে প্রথমে তা পাকস্থলীতে জমা হয়। সেখান থেকে অল্প অল্প করে হজমের জন্য খাবার অন্ত্রে প্রবেশ করে এবং শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে। তাছাড়া ক্ষুদ্রান্তের গঠনই এমন যে তা যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি গ্রহণ করতে সক্ষম। ২০ ফিট (৬ মিটার) দীর্ঘ ক্ষুদ্রান্তের শোষণ অঞ্চল ৩২০ বর্গফুট বা ৩০ বর্গ মিটার। এত বিশাল শোষণ অঞ্চলের অর্থ ক্ষুদ্রান্ত সহজেই যেকোনো খাবারের পুষ্টি গ্রহণে সক্ষম।
যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক মেডিকেল সায়েন্স বিষয়ক ওয়েবসাইট এমডিলিংক্সও ভরা পেটে ফলের পুষ্টি গ্রহণ কমে যাওয়াকে ভুল ধারণা বলে জানিয়েছে। হেলথলাইন থেকে রেজিস্টার্ড ডায়েটেশিয়ান টেইলর জোনসকে উদ্বৃত করে তারা লিখেছে, “গবেষণায় দেখা গেছে একজন মানুষ দিনে গড়ে যে পরিমাণ পুষ্টি গ্রহণ করে, পাকস্থলীর পুষ্টি গ্রহণের ক্ষমতা তার দ্বিগুণ।”
অর্থাৎ, আপনি ফল খালি পেটে খান কিংবা ভরা পেটে, পরিপাকতন্ত্রের পুষ্টি গ্রহণে কোনো তারতম্য হবে না।
সকালে ফল খেলে হজমে সুবিধা?
গত ২ ফেব্রুয়ারি সময় নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঘুম থেকে ওঠার পর ফল খেলে তা হজম হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। ফলে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং এনজ়াইমগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।” ডেইলি বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও একই দাবি পাওয়া যায়। দুটি প্রতিবেদনেই সূত্র হিসেবে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার নাম উল্লেখ আছে। একই ধরনের প্রতিবেদন পাওয়া যায় ঢাকা টাইমস ও দেশ রূপান্তরে। তবে সেখানে কোনো সূত্রের উল্লেখ করা হয় নি।
হেলথলাইন বলছে, এই ধারণার পেছনে কোনো যুক্তি নেই এবং এটিকে সমর্থন করার মতো কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তাদের মতে, পরিপাকতন্ত্রকে জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন হয় না এবং বেলা যখনই হোক জিভে খাবারের নাগাল পেলেই এটি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তাদের ভাষায়, “সত্য হলো ফল স্বাস্থ্যকর, দিনের যে কোনো সময়েই।”
একইভাবে পুষ্টিবিদ এরিন ফিটজেরাল্ড এমডিলিংক্সকে বলেন, “মধ্যাহ্নের আগেই ফল খেতে হবে এমন পরামর্শ আমি কখনোই আমার রোগীদের দেব না। যদি বলতেই হয় বলব যে আমাদের সারা রাতের উপবাস ‘ভঙ্গ’ করতে হবে প্রোটিন এবং/অথবা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট দিয়ে।”
তাঁর মতে, “সকালের খাবার হিসেবে ফলও স্বাস্থ্যকর, তবে সকাল সকাল বেশি পরিমাণে ফল খাওয়া ডায়াবেটিস রোগী কিংবা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।”
সকালে ও খালি পেটে ফল খাওয়ার মিথ যেভাবে ছড়ালো
ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট স্নোপসের মতে সকালে ফল খাওয়া যাবে না, এই ভ্রান্ত তথ্যটি সম্ভবত ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হার্ভে ডায়মন্ড ও ম্যারিলিন ডায়মন্ডের লেখা বেস্ট সেলিং বই ‘ফিট ফর লাইফ’ থেকে এসেছে। বইটির লেখা অনুযায়ী “দুপুরের আগে ফল ও ফলের রস খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়”।
বইটিতে আরও বলা হয়, “শুধুমাত্র খালি পেটে ফল খান, তা না হলে পাকস্থলীতে দীর্ঘক্ষণ ফল থেকে পচন ধরতে পারে”– বইটির এই বক্তব্য থেকেই সম্ভবত অন্যান্য খাবারের সঙ্গে ফল খেলে হজমে গণ্ডগোলের আরেকটি মিথেরও উদ্ভব হয়।
২০০১ সালে ইমেইলের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ইন্টারনেটে “খালি পেটে ফল খাওয়া” নিয়ে ভিত্তিহীন তথ্য ছড়াতে শুরু করে। সিঙ্গাপুরের রন্ধনশিল্পী ও লেখক দেভাগি সানমুগামের ১৯৯৮ সালের একটি লেখা থেকে বিষয়টি প্রচারিত হয়।
২০১০ সালে টিভি ব্যক্তিত্ব ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির কার্ডিওথোরাসিক সার্জারির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. ওজের নাম ব্যবহার করেও খালি পেটে ফল খাওয়া নিয়ে আরেকটি ভুয়া পোস্ট ছড়াতে থাকে।