তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভবিষ্যদ্বাণী আর ভুয়া তথ্য দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ

ফেসবুকের ভুয়া ‘অ্যানোনিমাস’ নেটওয়ার্ক

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভবিষ্যদ্বাণী আর ভুয়া তথ্য দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

২১ জুলাই। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয় রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার হল ভবনের ছাদে। ক্লাস চলাকালীন ভবনের ওপরই আছড়ে পড়ে যুদ্ধবিমানটি। সন্তানের খোঁজে আসা বাবা-মায়ের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, আহত শিশুদের কাউকে স্ট্রেচারে, কাউকে বা কোলে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। রাত বাড়ার সঙ্গে বাড়ে মৃতের সংখ্যা। হতাহতদের বেশিরভাগই শিশু।

পুরো দেশ যখন এই ঘটনায় শোকাহত তখনই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় মুখোশধারী এক ব্যক্তির ছবি ও পোস্ট। ‘অ্যানোনিমাস মেইন পেজ’ নামের একটি ফেসবুক পেজে একদিন আগেই পোস্ট করে জানানো হয়: “একটি স্কুল ভবন ধসে পড়বে, অনেক শিশু মারা যাবে… আমরা এই বিপর্যয়ের বিষয়টি আগে থেকেই জানি।” মুহূর্তেই ভাইরাল হয় পোস্টটি। বহু মানুষ ধরে নেয়, এটি সেই আন্তর্জাতিক হ্যাকার-অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ ‘অ্যানোনিমাস’, যারা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাইবার অ্যাটাক চালিয়ে সুপরিচিত।

ভাইরাল পোস্টের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে নানা জল্পনা-কল্পনা আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে, এটা কি শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি শিশুদের লক্ষ্য করে পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড? কেউ বলেন, যদি এই হ্যাকার গ্রুপ সত্যিই আগে থেকে জানায়, তবে বাংলাদেশ সরকার কেন সতর্ক হয়নি? মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওই পেজটির ফলোয়ার সংখ্যা বেড়ে যায় লাখখানেক। রাতে একই পেজ থেকে বাংলাদেশ নিয়ে প্রচারিত হয় বোমা হামলাসহ আরও কয়েকটি সতর্কতামূলক পোস্ট । এই পোস্টগুলোও মুহূর্তেই ভাইরাল হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব জল্পনা কল্পনার সূত্র ধরে অ্যানোনিমাস মেইন পেজটি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে ডিসমিসল্যাব। যাচাইয়ে এই পেজটি সহ আরও ২৫টি ফেসবুক পেজ পাওয়া যায় যারা বাংলাদেশের বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে একই ধরনের পোস্ট করে। ফেসবুকের পেজ ট্রান্সপারেন্সি থেকে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায় এসব পেজের অধিকাংশই পরিচালিত হচ্ছে নাইজেরিয়া থেকে। তবে যেসব ব্যক্তির ছবি বা ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে তারা ভিনদেশি, ভাষাও ভিন্ন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে পেজের পেছনে কাজ করছে কোনো পশ্চিমা হ্যাকার চক্র বা ‘গোপন তথ্য পাওয়া’ আন্তর্জাতিক শক্তি। 

ভুয়া ‘অ্যানোনিমাস’ নেটওয়ার্কের বিভিন্ন ফেসবুক পেজের স্ক্রিনশট

নেটওয়ার্কটি নিয়ে আরও অনুসন্ধান করতে গিয়ে ডিসমিসল্যাব খুঁজে পায় নাইজেরিয়াভিত্তিক গণমাধ্যম ‘হিউম্যান অ্যাঙ্গেল’-এর ২০২৪ সালের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে ২৪০টি একই ধরনের ‘অ্যানোনিমাস’- পেজ বিশ্লেষণ করে জানানো হয়, এগুলোর পেছনে রয়েছে নাইজেরিয়ার একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। নেটওয়ার্কটি আন্তর্জাতিক হ্যাকিং মুভমেন্ট ‘অ্যানোনিমাস’-এর ছদ্মবেশে নিয়মিত ভুয়া তথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ভিত্তিহীন অনুমান ছড়িয়ে নতুন ফলোয়ার টানার চেষ্টা করে এবং পরিশেষে নিশ্চিত জয়ের প্রতিশ্রুতিতে বিক্রি করে স্পোর্টস বেটিংয়ের টিকিট। বাংলাদেশ সম্পর্কিত ভুয়া ভবিষ্যদ্বাণীর পোস্ট করা কিছু পেজও আছে হিউম্যান অ্যাঙ্গেলের অনুসন্ধানে নথিভুক্ত পেজগুলোর মধ্যে। অর্থাৎ, এরা একই প্রতারক নেটওয়ার্কের অংশ।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো ছদ্মবেশী ‘অ্যানোনিমাস’

সামাজিক মাধ্যমে গত ২১ জুলাই সর্বপ্রথম অ্যানোনিমাস মেইন পেজ নামের একটি পেজ থেকে একটি পোস্ট ছড়াতে শুরু করে। পোস্টটি করা হয়েছিল উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনার এক দিন আগে, গত ২০ জুলাই। সেখানে ‘দ্য আর্কিটেক্ট’ নামে একজন দাবি করেন: “একটি স্কুল ভবন ধসে পড়বে, যেখানে অনেক শিশুর প্রাণ যাবে। আমরা একটি ভয়ংকর বিপর্যয় এগিয়ে আসতে দেখেছি।” তবে পোস্টটিতে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কোনো ইঙ্গিত ছিল না। বরং এতে বলা হয়, ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটবে এবং এই বিপর্যয় ঠেকানোর সবরকম চেষ্টা তারা করছে। 

একাধিক ফেসবুক পেজ থেকে গত ২০ জুলাই একটি স্কুল ভবন ধসের সতর্কবার্তা জানিয়ে করা পোস্ট

২১ জুলাই রাত সাড়ে ৮টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে মাত্র আড়াই ঘন্টার ব্যবধানে পেজটির অনুসারীর সংখ্যা দুই লাখ ২০ হাজার থেকে তিন লাখ ২০ হাজারের উপরে পৌঁছে। পেজটি থেকে অ্যানোনিমাস আর্কিটেক্ট, অ্যানোনিমাস ওয়েব, অ্যানোনিমাস অ্যাঞ্জেলস, ও অ্যানোনিমাস গোস্ট ইত্যাদি কাছাকাছি নামের আরও কয়েকটি পেজ শেয়ার ও ট্যাগ করা হয়। সবগুলো প্রফাইল ঘুরেই একই ধরনের পোস্ট দেখতে পাওয়া যায়। মূলত এই পাঁচটি পেজের পোস্টই সবচেয়ে বেশি শেয়ার হতে থাকে। তবে এই প্রতিবেদন লেখার সময় দেখা যায়, সবগুলো পেজই ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

বিমান বিধ্বস্তের দিন ২১ জুলাই একের পর এক পোস্ট আসে পেজগুলো থেকে, যেখানে, “আমরা আগেই জানতাম”, “বাংলাদেশ আমাদের কথা গুরুত্ব দেয় না”, “এটা দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড” এধরনের বক্তব্য আসতে থাকে। এমনকি গাউসিয়া মার্কেটে বোমা হামলা হবে এমন দাবিতেও একটি পোস্ট করা হয়। তাদের দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও ঢাকা এখনও নিরাপদ নয় এবং সামনে আরও বিপদ আসছে।

২১ জুলাই একাধিক পোস্টে বাংলাদেশ নিয়ে সতর্ক পোস্ট করে নেটওয়ার্কটির একাধিক পেজ।

পোস্টে বারবার নিজেদের ‘অ্যানোনিমাস’ পরিচয়ে তুলে ধরে চক্রটি। বাংলাদেশ সংক্রান্ত পোস্টের কী-ওয়ার্ড সার্চ করে হুবহু একই পোস্ট করা আরও অন্তত ২০টি পেজ খুঁজে পাওয়া যায়,  যা তাদের মধ্যে একটি সমন্বিত নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত দেয়। এই নেটওয়ার্কের পেজগুলোর নাম ঘুরেফিরে প্রায় একই ধরনের। যেমন- অ্যানোনিমাস রিজিয়ন, লর্ডস অব অ্যানোনিমাস, অ্যানোনিমাস লিজনিস্ট, ডার্ক ওয়েব অ্যানোনিমাস, অ্যানোনিমাস কালেকটিভ ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের নামের সঙ্গেই রয়েছে ‘অ্যানোনিমাস’, ‘লিজন’, ‘কালেকটিভ’, ‘ডার্ক ওয়েব’ বা ‘হ্যাকটিভিস্ট’-এর মতো শব্দ, যা মূল ‘অ্যানোনিমাস’ মুভমেন্টকে নকলের চেষ্টা। 

অধিকাংশ পেজই তৈরি হয়েছে ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে, এবং তাদের ফলোয়ার সংখ্যা কয়েকশো থেকে শুরু করে কয়েক লাখ পর্যন্ত। যেমন, অ্যানোনিমাস গ্রুপস পেজটির ফলোয়ার ৩ লাখের বেশি। বেশিরভাগ পেজের অ্যাডমিন লোকেশন নাইজেরিয়া, যদিও কয়েকজনের লোকেশন দেখা যায়নি। আবার কিছুক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সাইপ্রাস, যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার ঠিকানাও দেখিয়েছে। সব মিলিয়ে এসব নাম, লোকেশন, ও পোস্টের ধরন থেকে বোঝা যায় যে এগুলো একে অন্যের ক্লোন বা একই প্রতারণামূলক নেটওয়ার্কের অংশ।

পেজগুলোতে বিভিন্ন সময় ‘দ্য আর্কিটেক্ট’, ‘কমান্ডার এক্স’, ‘দ্য প্রফেসর’ ও ‘জিকা বলিভিয়া’ নাম ব্যবহার করে ছবি ও পোস্ট শেয়ার করতে দেখা যায়। এর মধ্যে ‘কমান্ডার এক্স’ চরিত্রটি সম্ভবত মূল ‘অ্যানোনিমাস’ গ্রুপের পরিচিত সদস্য ক্রিস্টোফার ডয়ন থেকে অনুপ্রাণিত। আবার প্রায়ই পেজগুলো থেকে একজন নিজেকে ‘দ্য আর্কিটেক্ট’ হিসেবে পরিচয় দেন। এই নামটিও এর আগে আসল ‘অ্যানোনিমাস’ গ্রুপের সঙ্গে বহুবার জড়ানো হয়েছে। 

মুখোশধারী ‘দ্য আর্কিটেক্ট’ ও ‘জিকা বলিভিয়া’। তবে তারা সরাসরি যুক্ত নাকি পরিচয় জালিয়াতির শিকার, তা স্পষ্ট নয়।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় পেজগুলোতে ‘জিকা বলিভিয়া’ নামের ব্রাজিলিয়ান একজন জনপ্রিয় মাস্কড ইউটিউবার ও ফুটবল বিশ্লেষকের নাম ও মুখোশধারী চরিত্র ব্যবহার করে ভিডিও পোস্ট করতে দেখা যায়। তিনি এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কি না, তা স্পষ্ট নয়। একইভাবে ‘দ্য প্রফেসর’ নামেও একজনকে দেখা যায় লাইভে ট্রেডিং নিয়ে কথা বলতে। তবে এসব ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

পেজগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া বড় কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে তারা বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক করার দাবি করে। যেমন, গত ১৩ জুলাই লন্ডনের সাউথএন্ড বিমানবন্দর থেকে নেদারল্যান্ডস যাওয়ার পথে  উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন ধরে আছড়ে পড়ে একটি বিমান। এ ঘটনায় চারজন নিহত হন। দ্য লিজিয়ন পেজ তাদের একটি পোস্টে তারা বিমান দুর্ঘটনার ভিডিও শেয়ার করে লিখে, “আমরা আগেই বলেছিলাম…ইউকে এয়ারলাইনসকে স্পষ্ট বার্তা পাঠানো হয়েছিল”। 

এছাড়া গত ২০ জুলাই ইন্দোনেশিয়ার তালিসে দ্বীপের কাছে মানাডোগামী একটি ফেরিতে আগুন লাগে। এ ঘটনায় ৫ জন নিহত হন এবং শতাধিক যাত্রী সাগরে ঝাঁপ দেন। এই ঘটনার একটি ভিডিও শেয়ার করে  লর্ডস অব এনোনিমাস নামের পেজের পোস্টে লেখা হয়, “আমরা ক্যাপ্টেনদের এবং শিপিং কোম্পানি পিটি সুরিয়া প্যাসিফিক ইন্দোনেশিয়াকে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়। স্পষ্ট মনে আছে, ওই প্রতিষ্ঠানের একজন আমাদের পাগল বলেছিলেন। এখন দেখুন কী ঘটেছে।”

বাংলাদেশের মতো যুক্তরাজ্য ও ইন্দোনেশিয়ায় ঘটা দুর্ঘটনার পরেও নেটওয়ার্কটি আগাম সতর্কবার্তা জানিয়েছিল বলে দাবি করে।

তবে এসব পেজ থেকে নানা সময় ভুয়া দাবিও ছড়াতে দেখা যায়। এই নেটওয়ার্কের সবচেয়ে বেশি তিন লাখ ফলোয়ার থাকা অ্যানোনিমাস গ্রুপ্স নামের পেজটি থেকে একটি গির্জায় আগুন লাগার ভিডিও শেয়ার করে পোস্টে দাবি করা হয়, “আলি” নামের এক মুসলিম ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে গির্জাটিতে আগুন দিয়েছেন এবং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু যাচাই করে দেখা যায়, এই দাবিটি সম্পূর্ণ ভুয়া। ঘটনাটি ঘটে গত ১৭ জুলাই, কানাডার কুইবেকে, যেখানে ১৮৮০ সালে নির্মিত ঐতিহাসিক একটি গির্জায় ঝড়ের সময় বজ্রপাতের কারণে আগুন লাগে। তীব্র বাতাসে সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, আগুনের উৎস ছিল বজ্রপাত। কোনো ব্যক্তির জড়িত থাকার কথা কোথাও উল্লেখ নেই।

হিউম্যান অ্যাঙ্গেলের প্রতিবেদন অনুসারে যেভাবে হয় প্রতারণা

২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অ্যানোনিমাস নাম ব্যবহার করে পরিচালিত একটি প্রতারণামূলক ফেসবুক নেটওয়ার্ক নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে নাইজেরিয়াভিত্তিক গণমাধ্যম হিউম্যান অ্যাঙ্গেল। ফেসবুকে সক্রিয় অন্তত ২৪০টি পেজ নিয়ে তারা অনুসন্ধানটি চালায় যেগুলোর নাম, কনটেন্ট ও কার্যক্রম প্রায় একই ধরনের। এই পেজগুলোর মোট অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২.৮৯ মিলিয়ন এবং বেশিরভাগই ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি।

ডিসমিসল্যাব ২৪০টি পেজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসারী থাকা ২০টি পেজ যাচাই করে চারটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কিত সেই ভুয়া ভবিষ্যদ্বাণীর পোস্টগুলো দেখতে পায়। এই চারটি ডিসমিসল্যাবের তালিকাতেও রয়েছে। ওই ২০টি মধ্যে ১১টিই আইডিই ছিল বন্ধ। অর্থাৎ, হিউম্যান অ্যাঙ্গেল যে নেটওয়ার্কটি সামনে আনে, সেই একই নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ নিয়েও ভুয়া সব ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করেছে।

আগাম সতর্ক পোস্ট। এধরনের পোস্টে সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা স্থানের নাম উল্লেখ থাকে না।

এই পেজগুলোও বেশিরভাগ নাইজেরিয়া থেকে পরিচালিত। হিউম্যান অ্যাঙ্গেলের প্রতিবেদন অনুসারে, নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এই পেজগুলো নিয়মিত নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভবিষ্যদ্বাণী ও ভুয়া হ্যাকিংয়ের ভিডিও শেয়ার করে।  এরপর তারা দাবি করে, তারা এমন কিছু “ফিক্সড ফুটবল ম্যাচ”-এর খবর জানে যেগুলোর ফল আগেই নির্ধারিত। এবার নিশ্চিত জয়ের প্রতিশ্রুতিতে বিক্রি করা হয় স্পোর্টস বেটিংয়ের টিকিট। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে বুধবার ও রোববার এই ম্যাচের টিকিট বিক্রি করা হয়। মূল্য কত পোস্টে তা সরাসরি বলা না থাকলেও অনেক ভুক্তভোগী হিউম্যান অ্যাঙ্গেলকে জানিয়েছেন, এই টিকিটগুলোর দাম ৩২০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি কিস্তিতে টিকিটের দাম পরিশোধের সুযোগও দেয় তারা। 

বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পেজগুলো বেটিং জিতেছে এমন ব্যক্তিদের ভুয়া রিভিউ শেয়ার করে। বিভিন্ন সক পাপেট অ্যাকাউন্ট দিয়ে ভুয়া স্ক্রিনশট, বেটিং স্লিপের ছবি শেয়ার করা হয়। তবে স্লিপের নম্বর বা যাচাইযোগ্য তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে কেটে বাদ দেওয়া থাকে, যাতে কেউ সেগুলোর সত্যতা যাচাই করতে না পারে। প্রতিবেদনটিতে নাইজেরিয়ান অনেক ভুক্তভোগী তাদের প্রতারণার অভিজ্ঞতার কথাও জানিয়েছেন।

ফিক্সড গেমের টিকেট বিক্রির পোস্ট

এই নেটওয়ার্ক ভুয়া মন্তব্য ও সক পাপেট অ্যাকাউন্ট দিয়ে কমেন্টে নিজেরাই নিজেদের প্রশংসা করে। হিউম্যান অ্যাঙ্গেল ২০২৪ সালের ১১ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ২০টি পোস্টের ৯০৯টি কমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখে, এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ কমেন্ট ছিল পুনরাবৃত্তিমূলক ও নির্দিষ্ট কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে, যেগুলোর অনেকগুলিই ‘টপ ফ্যান’ বা ‘রাইজিং ফ্যান’ ব্যাজধারী। এসব ভুয়া কমেন্টের ভিড়ে হারিয়ে যায় আসল ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। এমনকি কেউ যদি পেজগুলোতে সমালোচনামূলক মন্তব্য করে তবে অনেকসময় তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণাও চালায় এই নেটওয়ার্ক। এমন ভুক্তভোগীদের কথাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে। 

কীভাবে বুঝবেন কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভুয়া?

শুধুমাত্র বিদ্যাবুদ্ধিতে পিছিয়ে থাকা মানুষই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করেন এমন ধারণা ভুল। অনেক শিক্ষিত মানুষও অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির শিকার হন। এ ধরনের তত্ত্বগুলো সাধারণত যুদ্ধ, মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ছড়ায়, যখন মানুষ নিজেরাও মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। ঘটনার কার্যকারণের উত্তর না পেয়ে মানুষ একটি সহজ ব্যাখ্যা কিংবা দায় চাপানোর জন্য একজন ‘দোষী’ খোঁজার চেষ্টা করে। আর এই দুর্বল পরিস্থিতি থেকেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো সহজে ছড়ানোর সুযোগ পায়।  আর তাই কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আসলে যেভাবে তা যাচাই করবেন-

১। ‘শুধুমাত্র কিছু মানুষ এই সত্য জানে’- এমন দাবি করা হলে

অনেকে ভাবতে পছন্দ করে তারা অল্প কিছু “জ্ঞানী” মানুষের মধ্যে একজন, যারা প্রকৃত সত্য ধরে ফেলেছে। কিন্তু এমন দাবিই সবচেয়ে বেশি সন্দেহজনক।

২। যারা দাবি করছে, তারা আসলেই ওই বিষয়ে দক্ষ কিনা তা যাচাই করুন

যারা বিশেষজ্ঞ সেজে কথা বলছে তাদের কি আসলেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে কিনা যাচাই করুন।

৩। প্রমাণ দেখাতে না পেরে যদি বলা হয়, ‘প্রমাণ লুকানো হচ্ছে’

কোনো প্রমাণ হাজির করতে না পেরে যদি বলা হয়,“সব চাপা দেওয়া হচ্ছে”, “গভীর ষড়যন্ত্র আছে”- তখন বিষয়টি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখুন।

৪। তত্ত্বের বিপক্ষে যদি জোরালো ও একাধিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণ থাকে

যখন কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিপক্ষে বহু তথ্য, গবেষণা বা প্রমাণ পাওয়া যায়, তখন সেটা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

৫। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সঙ্গে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, বিশ্বনেতা কিংবা বৈজ্ঞানিক মহল জড়িত থাকার দাবি করা হলে

কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বে যদি বলা হয় কোনো বিশ্বনেতা, বিজ্ঞানীমহল বা গণমাধ্যম সবাই মিলে পরিকল্পিতভাবে একটি ঘটনা সৃষ্টি করেছে, তবে সেটি মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, কোনো বিষয়ে যত বেশি মানুষ জানে, তা গোপন রাখা ততটাই কঠিন।

৬। তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনায়

কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শুনায়, তবে সেটি কল্পকাহিনি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।  

দ্য কনভারসেশন দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও বিস্তারিত পড়ুন, কীভাবে বুঝবেন একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভুয়া।

আরো কিছু লেখা