ফামীম আহমেদ
ডা. দেবী শেঠি যেসব কথা বলেননি
ফামীম আহমেদ
ডা. দেবী শেঠি ভারতের একজন বিখ্যাত খ্যাতিমান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত “নারায়ণ হৃদয়ালয়” হাসপাতালটি বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়। ভারতের পদ্মশ্রী পদকসহ অনেক স্বীকৃতি পাওয়া এই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের যেকোনো স্বাস্থ্য-পরামর্শ তাই মানুষ খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে থাকে। তিনিও বিভিন্ন সময়ে লিখিত মতামত ও সাক্ষাৎকারে নানাবিধ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই তার বরাতে এমন অনেক স্বাস্থ্য-পরামর্শ দেখতে পাওয়া যায়– যেগুলো আসলে ডা. দেবী শেঠি বলেননি।
শুধু ফেসবুকে সার্চ করে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ডা. দেবী শেঠির নামের একাধিক বানান দিয়ে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার পোস্ট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বেশ কিছুকে ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করেছে একাধিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা। কিন্তু সেসব মিথ্যা দাবি এখনও সামাজিক মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে।
ডা. দেবী শেঠির বরাতে ফেসবুক, ইউটিউবে এবং মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচার হওয়া এমন কিছু ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য নিয়ে এই আয়োজন।
ভুয়া বরাতে ভাইরাল ২২টি ‘জরুরি’ পরামর্শ
করোনা ভাইরাসের বছর হিসেবে খ্যাত ২০২০ সালের মে মাসে ”করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাতে ২২টি জরুরি পরামর্শ” শিরোনামে ডা. দেবী শেঠির বরাত দিয়ে কিছু স্বাস্থ্য-পরামর্শ প্রকাশিত হয় দৈনিক কালের কন্ঠ, একুশে টিভি,ও দৈনিক নয়াদিগন্তের অনলাইন সংস্করণে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের একাধিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডা. দেবী শেঠি সেসময়ে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত এমন কোনো পরামর্শ দেননি। সে বছরের মার্চ মাসে টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে করোনা মহামারীতে করণীয় বিষয়ে একটি মতামত কলাম প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক, কিন্তু এই ‘জরুরি’ ২২টি পরামর্শের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দ্য কুইন্টকে জানান ডা. দেবী শেঠি।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের দুটি গণমাধ্যম তাদের ওয়েবসাইট থেকে খবরটি সরিয়ে ফেললেও দৈনিক নয়া দিগন্তের অনলাইনে এখনো সেটি রয়ে গেছে। অবশ্য সার্চ ফলাফলে ডা. দেবী শেঠির নামে ভাইরাল হওয়া ২২টি পরামর্শ সংক্রান্ত পোস্ট এবং খবরগুলো এখনো ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে এবং সংখ্যাটি ৭০০-র বেশি। ভাইরাল হওয়া এই ৭০০ পোস্টের মধ্যে ২০২০ সালের ৪টি পোস্ট শেয়ার হয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি বার। ইউটিউবেও একই দাবিতে বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে।
করোনা নির্ণয় পরীক্ষাকে অনুৎসাহিত করে ডা. দেবী শেঠির নামে ভুয়া অডিও
২০২০ সালে ডা. দেবী শেঠির নামে আরেকটি ভুয়া স্বাস্থ্য পরামর্শ মূলধারার সংবাদমাধ্যমসহ একাধিক সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০২০ সালের এপ্রিলে সময় টিভি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, যুগান্তর, বাংলানিউজ, একুশে টিভি অনলাইনসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে ”জ্বর হলেই করোনা পরীক্ষা নয়” শিরোনামে ডা. দেবী শেঠির বরাতে খবর প্রকাশ করা হয়েছিল।
মূলত দেবী শেঠির কথিত ৪ মিনিটের একটি অডিও রেকর্ডিংকে উদ্ধৃত করে নানা শিরোনামে এই পরামর্শটিকে খবর হিসেবে তুলে ধরেছিল সংবাদমাধ্যমগুলো। কিন্তু বুম বিডি, ভারতের অল্ট নিউজ, এএফডব্লিউএ, চেক ফর স্প্যাম সহ বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটের বরাতে জানা যায়, ডা. দেবী শেঠি এমন কোনো অডিও পরামর্শ দেননি। অডিওটি মূলত সন্তোষ জ্যাকব নামের ভিন্ন এক চিকিৎসকের।
পরবর্তীতে সময় টিভি অনলাইন তাদের খবরটি সংশোধন করলেও ডা. দেবী শেঠির নামে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া স্বাস্থ্য-পরামর্শ সম্বলিত খবর এবং ফেসবুক পোস্ট এখনো পাওয়া যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরুপ, ২০২০ সালের ১৯ মার্চ এই বিভ্রান্তিকর খবরটি দু’বার পোস্ট করা হয় এনটিভি অনলাইনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে। দুবারে প্রায় ২৫০ বার শেয়ার হওয়া এই ভুল খবরটি এখনো অনলাইন দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। ঢাকা টাইমস নামের আরেকটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। একই বিভ্রান্তিকর দাবিতে ইউটিউবেও ভিডিও পাওয়া গেছে।
সয়াবিনকে বিষ দাবি করে ভাইরাল হওয়া মন্তব্যটি ডা. দেবী শেঠির নয়
সম্প্রতি সয়াবিন তেলকে মানব শরীরের জন্যে বিষ এবং এটি ২০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় তৈরি হয় দাবিতে বেশ কিছু পোস্ট ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক এবং ইউটিউবে। এ দাবিগুলোর পক্ষে ভাইরাল পোস্টগুলোতে ডা. দেবী শেঠির বরাত দেয়া হলেও ডা. দেবী শেঠি কবে কোথায় এই ধরনের মন্তব্য করেছেন তার কোনো হদিস সেখানে পাওয়া যায়না।
পরবর্তীতে ডিসমিসল্যাব ডা. দেবী শেঠির হাসপাতালে যোগাযোগ করলে ডা. দেবী শেঠি জানান, তিনি এমন কোনো বক্তব্য দেননি। এছাড়া ডিসমিসল্যাবের রিপোর্টে ডা. দেবী শেঠির নামে প্রচারিত এই ভুয়া বক্তব্যটি কিভাবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তার সবিস্তার উল্লেখ আছে।
এছাড়া, গত নভেম্বরে বাংলাদেশি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানারও এটি যাচাই করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
না, চিরতরুন থাকার ‘টিপসগুলো’ ডা. দেবী শেঠি দেননি
“চির তরুণ থাকার টিপস – ডা. দেবী শেঠী” শিরোনামে এ বছর ফেসবুকে ১৪ টি পরামর্শ সম্বলিত একটি পোস্ট ভাইরাল হয়। পরে গত আগষ্ট মাসে বাংলাদেশভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং উদ্যোগ রিউমর স্ক্যানারকে ডা. দেবী শেঠির হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, এই টিপস বা পরামর্শগুলো ডা. দেবী শেঠির নয়।
কিন্তু চিরতরুন থাকার টিপসগুলো এখনো শেয়ার হচ্ছে। এমনকি গত ৭ অক্টোবর এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট করা হয় একটি বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রুপে যেটি এখন পর্যন্ত ২৫০ বারের বেশি শেয়ার হয়েছে। আরো দেখা যাচ্ছে, এই বিভ্রান্তিকর টিপসগুলো মাত্র ৩টি ফেসবুক গ্রুপ থেকে ১ হাজার বারের মত শেয়ার হয়েছে।
এছাড়া ২১ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের কন্নড়ভিত্তিক সিনেমার নায়ক পুনিথ রাজকুমারের মৃত্যুর পরপর ডা. দেবী শেঠির নামে একটি ভুয়া ‘বার্তা’ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ‘“This is a msg. from Dr.Devi Shetty.” শিরোনামে ছড়িয়ে পড়া এই বার্তাটিকেও ভিত্তিহীন বলে চিহ্নিত করে ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলো। ভারতের ওয়েবকুফ, নিউজচেকার, ফ্যাক্টলির মাধ্যমে জানা যায়, ডা. দেবী শেঠি এই নায়কের মৃত্যু নিয়ে কোনো ‘বার্তা’ দেননি।
ডা. দেবী শেঠির নামে কোনো বক্তব্য নিউজফিডে এলে কী করবেন?
ইতোমধ্যে জেনেছেন, নানাসময়ে বিশেষ করে স্বাস্থ্য-সংকটের সময়গুলোতে প্রভাবশালী চিকিৎসক ডা. দেবী শেঠির নামে কী ধরনের ভুয়া বক্তব্য প্রচারিত হয়। দেবী শেঠির উদ্ধৃতি দিয়ে সয়াবিনকে বিষ বলে দাবি করা পোস্টে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে কমেন্ট করেছেন যে, “বিকল্প কী?” বা “তাইলে কি দিয়ে রান্না করবো?” কেউ আবার লিখেছেন যে, “অজানা তথ্য জানানোর জন্য ধন্যবাদ। এগুলো আমাদের সচেতন হতে সাহায্য করবে।” অনেকেই এই দাবিটি বিশ্বাস করছেন, এমনকি সয়াবিনের বিকল্পও খুঁজছেন। তাই ডা. শেঠি বা যেকোনো চিকিৎসকের বরাতে কোনো বক্তব্য বা পরামর্শ আপনার চোখে পড়লে সেটি যাচাই করে নেওয়া ভালো।
সাধারণত ডা. দেবী শেঠির বক্তব্য বা স্বাস্থ্য পরামর্শগুলো তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘নারায়ণ হেলথ’ এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ, টুইটার হ্যান্ডেল এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এছাড়া নারায়ণ হেলথের একটি ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে। এর বাইরেও তিনি ভারতের একাধিক পত্রিকায় স্বনামে তার মতামত ব্যক্ত করে থাকেন। তাছাড়া যেকোন জরুরি জিজ্ঞাসায় নারায়ণ হেলথের অফিশিয়াল ই-মেইলেও যোগাযোগ করা যেতে পারে।
ইতিমধ্যে ডা. দেবী শেঠিকে নিয়ে বাংলাসহ একাধিক ভাষায় বেশ কিছু বিভ্রান্তিমূলক ও অসত্য দাবির ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাই তার নামে যেকোনো বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে সেটি গুগলে সার্চ করলে সে সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনও খুঁজে পাবেন।