শোয়েব আবদুল্লাহ
আপনার দানের টাকা প্রতারকের পকেটে যাওয়ার আগে যাচাই করে নিন
শোয়েব আবদুল্লাহ
পোস্টটির কথাগুলো এরকম: “আমার মেয়ের অবস্থা খুব খুব খারাপের দিকে ভাই একটু দয়া করুন প্লিজ আমার মেয়ের চিকিৎসা সম্পন্ন করতে ভাই একটু দয়া করুন প্লিজ ভাই আমি একজন এতিম অসহায় বাবা হয়ে আপনাদের সবার দুটি পায়ে ধরে আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে একটু ভিক্ষা চাইছি ভাই দয়া করুন প্লিজ সবাই মিলে ভাই আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে ভাই যে যতো টুকু পারেন একটু ভিক্ষা দেন ভাই ১০০/২০০/৫০০/১০০০ করে আমার মাসুম অসুস্থ মেয়ের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসার জন্য ভাই একটু দয়া করুন ভাই প্লিজ।”
পোস্টটিতে এক বাবা তার অসুস্থ মেয়ের জন্য সহায়তা চাইছেন। সঙ্গে যুক্ত আছে অসুস্থ এক শিশুর ছবি এবং একটি বিকাশ নম্বর। কিন্তু ‘হৃদয়গ্রাহী’ বাক্যগুলোকে ফেসবুকে সার্চ করে দেখা গেল, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত একই বাক্য দিয়ে সাহায্যের অন্তত ৯ টি আলাদা আবেদন করা হয়েছে, যা অন্তত ৪০০ বার বিভিন্ন আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে।
এই ৯টি ফেসবুক পোস্টের বিবরণ এক, কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তির নাম-পরিচয়, ছবি এবং টাকা পাঠানোর ফোন নম্বর আলাদা। বেশ কিছু পোস্টে সাহায্য পাঠানোর জন্য একাধিক মোবাইল নম্বর রয়েছে, তবে একটি নির্দিষ্ট নম্বর পাওয়া গেল তিনটি পোষ্টে। নাম্বারটি হলো: 01826088585।
এবার সেই ফোন নম্বর দিয়ে ফেসবুকে সার্চ করে ভিন্ন পরিচয় এবং ভিন্ন ছবিসম্বলিত অন্তত ১৫টি আলাদা সাহায্যের আবেদন পাওয়া যায়। প্রতিটিতে অসুস্থ ব্যক্তির বিবরণ ও ছবি আলাদা, কিন্তু সাহায্য পাঠানোর বিকাশ নম্বরটি একই।
যেমন: ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানার মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের নামহীন এক বছরের ছেলের জন্য সহায়তা পাঠানোর বিকাশ নম্বর 01826088585; একই নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার তাহমিদ হাসানের মেয়ে আয়েশা এবং নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার কাচারিবাজার গ্রামের আইয়ুর আলীর শিশু সন্তান সবুজের চিকিৎসায় টাকা পাঠানোর জন্যেও!
এত মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা যে নম্বরে নেয়া হচ্ছে, সেটি কোনো সামাজিক সংস্থার কিনা- জানতে ‘01826088585’ নম্বরে কল দিলে একজন নারী ফোন রিসিভ করেন। নিজের নাম ‘জাহানুর’ দাবি করে তিনি বলেন, অসুস্থ শিশুটি তার ছেলে। ডাক্তারের কোনো ব্যবস্থাপত্র আছে কিনা দেখতে চাইলে তিনি দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। শিশুটি ছেলে হলেও কিছু পোস্টে মেয়ে শিশুর জন্যে সাহায্যের আবেদন কেন পোস্ট করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কল কেটে দেন।
যাচাই হয়, সুরাহা হয় না
এবার আরেকটি ফেসবুক পোস্ট দেখা যাক। ‘Md Sujon Miah’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে গত ১২ এপ্রিলে নিচের পোস্টটি করা হয়েছে। পোস্টটির বেশিরভাগ অংশই পূর্বে আলোচিত বাক্যগুলোর সাথে মিলে যায় এবং ফোন নম্বরটিও সেই একই “01826088585”। সেখানে একটি শিশু ও তার পিতা-মাতার চারটি ছবি যুক্ত করা হয়।
কিন্তু ছবিগুলো কোনো বাংলাদেশি শিশুর নয়। ফেসবুকের থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা বুম বাংলাদেশ ও রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ছবিগুলো ভারতীয় শিশু ফাইজানের এবং সে ‘অরাই মিউটেশন’ রোগে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার বারের বেশি শেয়ার হওয়া এই পোস্টে একজন মন্তব্যকারী ভারত থেকে কিভাবে টাকা পাঠানো যায় তাও জানতে চেয়েছে। দুটি সংস্থা ফ্যাক্টচেক করার পরও পোস্টটি বহাল তবিয়তেই টিকে আছে।
সাহায্যের আবেদন বন্ধ হলেও থামেনা অর্থ উত্তোলন
‘Ajmira vlogs family’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে একটি শিশুর একাধিক ছবি এবং মেডিকেল রিপোর্ট পোস্ট করে সাহায্যের আবেদন জানানো হয় গত ৩১ অক্টোবর। রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পোস্টের এই একই শিশুর দুইটি ছবি এবং মেডিকেল রিপোর্টগুলো নেয়া হয়েছে ভিন্ন আরেকটি পেজ থেকে। সেই পেজে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ছবিগুলো পোস্ট করে শিশু ফাবিহার চিকিৎসার জন্যে আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল।
এই পেজের সর্বশেষ পোস্টে বলা হয়েছে, শিশু ফাবিহা গত ২১ অক্টোবর মারা গেছে কিন্তু এখনো তার নামে আর্থিক সাহায্য উত্তোলন এখনো চলছে। সেই ২১ অক্টোবর থেকে এই প্রতিবেদন লেখার দিন পর্যন্ত ২৮টি ফেসবুক পোস্ট পাওয়া গেছে যেখানে মৃত ফাবিহার ছবি এবং তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ফাবিহার বাবা ফিহানুর রহমান জানেন না এসব পোস্ট দিয়ে কারা টাকা তুলছেন।
একই ধরনের বিড়ম্বনায় আছেন মো. মারুফ হাসান। তার বিড়ম্বনা নিয়ে একটি ফ্যাক্টচেক করেছিল বুম বাংলাদেশ। সেই খবর থেকে জানা যায়, ছোট্ট শিশুকন্যা তুবার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়ে তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছিলেন। গত ২১ জানুয়ারি তুবা মারা গেলে, আর সাহায্য গ্রহণ করা হচ্ছে না জানিয়ে মারুফ ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট করেন। কিন্তু পুরোনো পোস্ট থেকে কে বা কারা শিশুটির ছবি নিয়ে নাম বা সাহায্য প্রেরণের নম্বর পরিবর্তন করে নতুন নতুন আবেদন পোস্ট করতে থাকে।
বুম বাংলাদেশকে মারুফ বলেন, “নিজের মৃত শিশুকে নিয়ে এসব দেখলে কতটা কষ্ট হয় তা বোঝাতে পারব না ভাই।”
২০১৫ সালের ২ জুলাই “শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগেই কেয়াকে যেতে হলো হাসপাতালে” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে। প্রতিবেদনে কেয়া খাতুন নামে ক্যান্সারে আক্রান্ত এক তরুণীর জন্য সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। পরবর্তীতে “কেয়ার মুখে হাসি, চোখে স্বপ্নের ঝিলিক” শিরোনামে কেয়া খাতুনের চিকিৎসা চলার ফলোআপ প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয় একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর।
কিন্তু তার ৭ বছর পর ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে এই রিপোর্ট লেখার আগের দিন একই ছবি ব্যবহার করে ‘ফাতেমা’ নামের একজন নারীর জন্যে আর্থিক সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে। অথচ এ বছরের জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বুম বাংলাদেশ এবং রিউমর স্ক্যানার।
বিশ্বাসের ব্যবসা
খোরশেদ আলমের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। অবসর জীবন যাপন করছেন। সামাজিক মাধ্যমে নতুন হলেও বেশ সক্রিয় বিশেষভাবে ফেসবুকে। দিনের অনেকটা সময় ফেসবুক এবং ইউটিউবে ব্যয় করেন। প্রতিদিনই বিভিন্ন কন্টেন্ট শেয়ার করেন যার মধ্যে রাজনীতি, বিনোদন, ইতিহাস কিংবা হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান চাওয়ার পোস্ট; সব আছে। গত কয়েক মাসে তিনি বেশ কয়েকবার সাহায্যের আবেদনসংবলিত ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করেছেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে। এসব পোস্টে অসুস্থ কোনো শিশুর ছবির সাথে মোবাইল ফোনভিত্তিক ডিজিটাল আর্থিক নাম্বারও যুক্ত করা আছে সাহায্যের অর্থ পাঠানোর জন্য। খোরশেদ জানান এরকম কয়েকটি নাম্বারে তিনি সাধ্যমত সহযোগিতাও করেছেন। সাহায্যে পাঠানোর আগে যাচাই করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন- “কেবল ফোন নাম্বারে ফোন করেছিলাম। নিজের সন্তানের ছবি দিয়ে কেউ কি মিথ্যে বলবে?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতের ভাবনাও অনেকটা একই রকম। ফেসবুকে সাহায্যের আবেদন দেখে অর্থ সহযোগিতা করেছেন তিনিও। এসকল সাহায্যের আবেদন সঠিক কিনা তা কিভাবে যাচাই করেন? “ফোন করে জেনে নেই। পোস্টে প্রেসক্রিপশন থাকে। এর বাইরে যাচাই করা হয় না আসলে”, বলছিলেন জান্নাত।
তারা উভয়েই মনে করে একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে মানুষকে সাহায্য করা তাদের কর্তব্য। সামাজিক মাধ্যম বর্তমান এরকম সাহায্যে ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে, বিশেষত ভিন্ন দুর্যোগের মুহুর্তে। কিন্তু এসবের মাঝে আছে আবার অর্থ লোপাট হয়ে যাওয়ার নানা রকম ফাঁদও।
প্রশ্ন হলো, এ ধরনের ফাঁদ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাব্য কী? ফেসবুকের থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেকিং পার্টনার ফ্যাক্ট ওয়াচের পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুমন রহমান জানান, “দুঃস্থদের সাহায্য করার চর্চা আমাদের আছে। তাই যারা সাহায্য করবেন তাদের জন্যে আমাদের বার্তা হচ্ছে, একটু যাচাই করে সাহায্য করুন। সবাই হয়ত (রিভার্স) ইমেজ সার্চ করবেন না। কিন্তু পোস্টে পাওয়া ফোনে অন্তত যোগাযোগ করে জানা যেতে পারে। কিংবা সাহায্য করার আগে যদি আমাদের মত ফ্যাক্টচেকারদের কাছে পাঠানো যায়, আমরা তৎক্ষণাৎ সেই আবেদনটির ব্যাপারে আমরা মতামত জানাতে পারব”। নিউজফিডে আসা এরকম সাহায্যের আবেদন যিনি পোস্ট বা শেয়ার করছেন তার পরিচয় পরখ করারও পরামর্শ দেন তিনি।