আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
নভেম্বর ২৩, ২০২৫
১৮:৪৭:০০
ভূমিকম্প নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানো থামাতে মাথায় রাখুন তিন বিষয়  

ভূমিকম্প নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানো থামাতে মাথায় রাখুন তিন বিষয়  

নভেম্বর ২৩, ২০২৫
১৮:৪৭:০০

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

গত ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ কেঁপে উঠেছিল ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে। ৫.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ১০ জন নিহত হয়েছেন, অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনাও। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী ঢাকার খুব কাছে, নরসিংদীর ঘোড়াশালে। এরমধ্যে ২২ নভেম্বরে আরও তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে। এই দুর্যোগের মধ্যে নানা ধরনের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ও ভিডিও মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দুর্যোগের সময়ে অপতথ্যের বিস্তার সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়, যা দুর্যোগ মোকাবিলায় বাধা তৈরি করে। 

২২ নভেম্বরের ভূমিকম্পের পর বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও যাচাই করে দেখেছে ডিসমিসল্যাব যার কোনোটি পুরোনো, কোনোটি ভিন্ন দেশের অথবা কোনোটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি।

বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ছবি

২১ নভেম্বরে একটি ফেসবুক গ্রুপে একজন ব্যবহারকারী তিনটি ছবি পোস্ট করে ভূমিকম্প নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন। তিনটি ছবিতেই দেখা যাচ্ছে ধ্বসে যাওয়া কয়েকটি ভবনের দৃশ্য। ছবিগুলো যাচাই করতে গেলে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায় ছবির ঘটনাগুলো একটিও বাংলাদেশের নয়।

  • গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে পর ছড়ানো ধরণের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন
  • গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে পর ছড়ানো ধরণের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন
  • গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে পর ছড়ানো ধরণের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন

প্রথম ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে দেখা যায় এটি মূলত ২০১৫ সালে নেপালে হওয়া একটি ভূমিকম্পে ধ্বসে যাওয়া ভবনের দৃশ্য। দ্য গার্ডিয়ানের ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই ছবিটি দেখা যায়। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা, “কাঠমান্ডুতে ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পের পর ধসে পড়া ভবন।” ২০১৫ সালের এপ্রিলে নেপালে হওয়া ৭.৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পে নেপালে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। সেই ঘটনার ছবিই বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমের বাংলাদেশে হওয়া ভূমিকম্পের সংবাদে ব্যবহার করতে দেখা গেছে (,,)।

  • গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে পর ছড়ানো ধরণের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন
  • গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে পর ছড়ানো ধরণের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন

দ্বিতীয় ছবিটি যাচাই করতে গেলে দেখা যায় এটি জাপানের একটি ভবন ধ্বসে যাওয়ার দৃশ্য। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার সূত্র মতে ১৯৯৫ সালে জাপানের কোবেতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়া একটি ভবনের দৃশ্য এটি। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের জাপানে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।

তৃতীয় ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায় এটি তাইওয়ানে ভূমিকম্পে ধ্বসে যাওয়া একটি ভবনের দৃশ্য। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই ছবিটি যুক্ত করে লেখা হয়, “তাইওয়ানের হুয়ালিয়েনে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে আঘাত হানা ভূমিকম্পের পর ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের পাশে উদ্ধারকর্মীদের দেখা যাচ্ছে।” তাইওয়ানে হওয়া এই ভূমিকম্পে ১৭ জন মানুষ মারা যায় এবং আহত হয় আড়াই শরও বেশি মানুষ।

“কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশে ভূমিকম্প হয়েছিল”- এই ক্যাপশনে একজন ব্যবহারকারীকে পোস্ট করতে দেখা যায় ফেসবুকের একটি গ্রুপে। পোস্টের সঙ্গে যুক্ত করা হয় তিনটি ছবি। এর মধ্যে একটি ছবি একটু আগে উল্লেখিত নেপালের ভূমিকম্পের ঘটনার ছবিটি। অন্য দুটি ছবির ফ্যাক্টচেকেও দেখা যায় এগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক নেই।

  • গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে পর ছড়ানো ধরণের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন
  • গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে পর ছড়ানো ধরণের ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন

পোস্টের একটি ছবিতে রাস্তা ভেঙে দুই ভাগ হয়ে ধ্বসে পড়ার চিত্র দেখা যায়। ছবিটি যাচাই করতে গেলে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায় এটি সাম্প্রতিক কোনো ছবি না। ছবি বেচাকেনার সাইট আইস্টকে একই ছবি দেখা যায়। সাইটে ছবিটির আপলোড তারিখ দেখা যায় ২০১৩ সালের ১৮ এপ্রিল।

আরেকটি ছবিতেও রাস্তা ফেটে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। ছবিটি যাচাইয়ে দেখা যায় এটিও বাংলাদেশের কোনো দৃশ্য নয়। এটি মূলত চলতি বছরের মার্চে মিয়ানমারে হওয়া ভূমিকম্পের একটি দৃশ্য। এই বছরের ২৯ এপ্রিলে বিবিসি বাংলার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে গেটি ইমেজের সূত্রে এই ছবি সম্পর্কে লেখা হয়, “ভূমিকম্পে মিয়ানমারের নেপিডো’র সড়কে ফাটল ধরেছে।” চলতি বছরের ২৮ মার্চে মায়ানমারে হওয়া ৭.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পে  ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।

ভূমিকম্পের এআই নির্মিত ছবি ও ভিডিও

“ঢাকায় বিশাল মাত্রায় ভু*মিকম্পে বিল্ডিং হেলে পরলো,, লোকেশন : বাড্ডা লিংক রোড”- ক্যাপশনে একটি ভিডিও পোস্ট হতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। ভিডিওতে দেখা যায় লাগোয়া দুটি ভবন থেকে হঠাৎ করে ইট খুলে পড়ছে, সঙ্গে ছাদ থেকে এসির ফ্যান পড়তে দেখা যায়। ভিডিও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শুরুতে ছাদ থেকে দুটি এসির ফ্যান পড়ছে। তৃতীয় সেকেন্ডে নিচের ফ্যানটি হঠাৎ দুই ভাগ হয়ে গিয়ে ভবনের ভগ্নাংশের রূপ নেয়।

যদিও ভবনের ঐ নির্দিষ্ট অংশে তখনো কোনো ফাটল ভাঙা দেখা যায় না। এছাড়া ভাঙা বস্তুগুলোর পড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায় অসামঞ্জস্য। একটি বারান্দার গ্রিল হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। একই সঙ্গে পড়তে শুরু করলেও ছোট বস্তু আগে মাটিতে পড়লেও বড় বস্তুটি কিছুটা ধীর গতিতে পড়ছে। তবে কোনো এআই জেনারেশন মডেলের চিহ্ন দেখা যায়নি।

ডিপফেইক ভিডিও শনাক্তের টুল ডিপফেইক-ও-মিটারের একটি মডেল “এভিএসআরডিডি ২০২৫” এই ভিডিওকে শতভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে নির্মিত বলে নিশ্চিত করে।

সূত্র যাচাই করতে গেলে দেখা যায় এটি মূলত বাড্ডায় হেলে পড়া একটি ভবনের স্থিরচিত্র থেকে তৈরি করা হয়েছে। হুবহু একই দৃশ্য ধারণ করে এমন একটি ছবিসহ আরটিভি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যার শিরোনাম, “ভূমিকম্প: বাড্ডায় হেলে পড়েছে ভবন।” প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীর বাড্ডার লিংক রোড এলাকায় একটি ভবন হেলে পড়েছে। 

এছাড়া, ভূমিকম্পে ভবন ধ্বসে পড়ার দাবিতে ছড়ানো একাধিক ছবি ও ভিডিওকে এআই জেনারেটেড হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচ (,,)।

ভুল দাবি গণমাধ্যমে

ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার রাফিন প্লাজা ভূমিকম্পে হেলে পড়েছে এমন দাবিতে একাধিক গণমাধ্যম সংবাদ (,,) প্রকাশ করে ২১ নভেম্বরে। তবে, গুগল স্ট্রিটের পুরোনো ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভবনটির ডিজাইনই এমন। এটি হেলে পড়ার দাবিটি সত্য নয়। এটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। 

দুর্যোগের সময় তথ্য যাচাইয়ে করণীয়

ড. ইরিনা ডালো, ড. মারিনা কোররাডিনি, লর ফাল্লো এবং ড. মিশেল মার্টির লেখা একটি নির্দেশিকা “কীভাবে ভূমিকম্প বিষয়ক অপতথ্যের মোকাবিলা করা যায়? একটি যোগাযোগ নির্দেশিকা”তে লিখেছেন, জরুরি অবস্থার সময় তথ্য প্রাপ্তিকে মানুষের জন্য খাদ্য বা আশ্রয়ের মতোই অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। মোবাইল এবং ডিজিটাল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের উন্নয়নের ফলে, জনসাধারণ “তাৎক্ষণিক, সঠিক তথ্য” পাওয়ার প্রত্যাশা রাখে। তবে, যে যোগাযোগ প্রযুক্তিগুলো তাৎক্ষণিক সতর্কতা প্রদান করতে পারে, তথ্যের আধিক্য এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণে সেই একই প্রযুক্তি ভুল বা অপতথ্য দ্রুত বিস্তারেও সাহায্য করে। এর দ্বারা সৃষ্ট প্রাথমিক হুমকি হলো ভুল বা ক্ষতিকর পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা, এতে আর্থিক ও জীবননাশের মতো ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকে। তাই, ভুল তথ্যকে প্রতিরোধ বা প্রশমন করা জরুরি, এমনকি সেটি ভুল করে ছড়ালেও।

নির্দেশিকাতে ভূমিকম্প বিষয়ক অপতথ্য মোকাবিলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ/প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনটি নীতির কথা বলছে। বলা হয়েছে, অপতথ্য প্রতিরোধ এবং মোকাবিলার জন্য বিজ্ঞানী ও প্রেক্টিশনারদের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র তথ্য ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিতরণ করা যথেষ্ট না। এক্ষেত্রে প্রথম নীতি হলো, দর্শক/শ্রোতা/পাঠক/জনসাধারণের মানসিকতা বুঝতে হবে। দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগকে উপযোগী করতে কী ধরনের তথ্য, কীভাবে এবং কখন তা সরবরাহ করা হবে সেটা বোঝা জরুরি।

দ্বিতীয় নীতি হলো বার্তাকে পরিমার্জন করতে হবে। তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা এড়ানোটা মূল লক্ষ্য। বিশেষত জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে, বার্তাকে বোধগম্য করতে দৃশ্যমান উপকরণ ও উদাহরণের ব্যবহার করা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে পরিচিত ধরণ ব্যবহার করা, যেমন সম্ভাবনা ও ঝুঁকি সম্পর্কে সংখ্যাগত ও মৌখিক বর্ণনার সমন্বয় করা। এক্ষেত্রে যোগাযোগকে অবশ্যই সহানুভূতিশীল, অন্তর্ভূক্তিমূলক হতে হবে এবং তথ্যের আধিক্য এড়াতে হবে।

তৃতীয় নীতি হলো, সম্পর্ক স্থাপন করা ও প্রত্যাশাকে সামলানো। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ভূমিকম্প হওয়ার আগেই জনসাধারণের কাছে আস্থার জায়গা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। জনসাধারণ যেন আগেই জানতে পারে কী আশা করতে পারে এবং কোন ধরণের তথ্য আশা করতে পারে না, কখন আশা করতে পারে এবং কোন মাধ্যমে আশা করবেন। যেহেতু ভুল তথ্য ভূমিকম্পের আগে, চলাকালীন অথবা পরে- যেকোনো সময়েই ছড়াতে পারে, তাই এর প্রতিরোধ একটি স্থায়ী প্রক্রিয়া।

আরো কিছু লেখা