ফামীম আহমেদ

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব
নেদারল্যান্ডসে পাখি মৃত্যুর সঙ্গে ফাইভ জি-র সম্পর্ক থাকার প্রমাণ নেই
This article is more than 2 years old

নেদারল্যান্ডসে পাখি মৃত্যুর সঙ্গে ফাইভ জি-র সম্পর্ক থাকার প্রমাণ নেই

ফামীম আহমেদ

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পত্রিকার প্রতিবেদনের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে যে, নেদারল্যান্ডসে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ জি চালুর প্রতিক্রিয়ায় কয়েকশ পাখি মারা গেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পত্রিকার প্রতিবেদনটির শিরোনাম “পরীক্ষামূলকভাবে ৫জি চালু হতেই নেদারল্যান্ডসে মৃত্যু কয়েকশো পাখির।”

ফেসবুকে সার্চ করে দেখা গেছে, একই ছবি ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে ছড়ানো হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর কয়েকটি পোস্ট দেখুন এই লিংকগুলোতে: ২০১৮, ২০১৯, ২০২০, ২০২১, ২০২২, ২০২৩। এর মধ্যে শুধু ২০১৯ সালের একটি পোস্ট শেয়ার হয়েছে ২৯০০ বারের বেশি।

একই দাবি ২০১৮ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের (, , , ) সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। 

তবে একাধিক ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, পরীক্ষামূলক ফাইভ জি চালুর কারণে পাখি মারা যাওয়ার দাবিটি বেঠিক।

ছবির খবরটির উৎস কী

ফেসবুকে প্রচারিত ছবিটির বাম পাশে নিচের দিকে ইংরেজিতে “Bartaman, 08.12.18, Siliguri” লেখা রয়েছে। সার্চ করে একই তারিখে একই শিরোনামে ‘বর্তমান পত্রিকা’ নামের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট পাওয়া গেছে।

২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বরের এই পোস্টে সংযুক্ত বর্তমান পত্রিকার ওয়েবসাইটের লিংকটি এখন আর সক্রিয় নয়।

বর্তমান পত্রিকার প্রতিবেদনে (ভাইরাল হওয়া ছবির টেক্সট থেকে পাঠ করা) খবরের সূত্র হিসেবে ‘গ্যালাক্টিক কানেকশন‘ নামে একটি ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের ভেতরে বলা হয়েছে: “পরীক্ষামূলকভাবে ৫জি ইন্টারনেট পরিষেবা চালুর পর নেদারল্যান্ডসের একটি পার্কে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৩০০ পাখি।” আরো বলা হয়েছে, “প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে ডাচ রেল স্টেশনে ৫জি পরিষেবা চালু পরীক্ষামূলকভাবে হতেই এই ঘটনা।”

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের আরও যেসব সংবাদমাধ্যম এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করেছে তার মধ্যে দৈনিক যুগান্তরকালের কণ্ঠ তাদের প্রতিবেদনে খবরের সূত্র হিসেবে ‘প্রিন্সিপিয়া সায়েন্টিফিক ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়েছে।

গ্যালাক্টিক কানেকশন এবং ‘প্রিন্সিপিয়া সায়েন্টিফিক ইন্টারন্যাশনাল’-এর প্রতিবেদনে কী আছে?

বর্তমান পত্রিকার প্রতিবেদনে গ্যালাক্টিক কানেকশন নামে একটি ওয়েবসাইটের বরাত দেয়া হয়েছে। কিন্তু গুগলে সার্চ করে দেখা যায় ওয়েবসাইটির অস্তিত্ব এখন আর নেই। তবে আর্কাইভ ডট কম থেকে গ্যালাক্টিক কানেকশনের সেই প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া গেছে।

সেখানে জন কুলে নামক এক ব্যক্তির ফেসবুক পেজের পোস্টকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার পরিচয় হিসেবে লেখা হয়েছে “ফেসবুকের ‘স্টপ ৫জি’ গ্রুপ ও স্টপ৫জি ডট নেট-এর প্রতিষ্ঠাতা”। 

কালের কণ্ঠ ও যুগান্তরের প্রতিবেদনে সূত্র হিসেবে “প্রিন্সিপিয়া সায়েন্টিফিক ইন্টারন্যাশনাল” নামে যে ওয়েবসাইটের বরাত দেয়া হয়েছে, সেই ওয়েবসাইট তাদের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর। এখানেও তথ্যের সূত্র হিসেবে জন কুলের বরাত দেয়া হয়েছে।

অর্থাৎ, সবগুলো প্রতিবেদনের খবরের সূত্রেই এই এক ব্যক্তি।

কে এই জন কুলে?

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান জন কুলে নামের এই ব্যক্তিকে “কনস্পিরেসি থিওরিস্ট” হিসেবে তাদের প্রতিবেদনে চিহ্নিত করেছে।

মার্কিন ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান স্নোপস দেখিয়েছে, বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণ ছাড়া নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করে থাকেন জন কুলে। বিশেষ করে ৫জি বিরোধী নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারকারী কয়েকটি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তিনি পরিচালনা করেন।

নেদারল্যান্ডসে পাখিগুলো মৃত্যুর কারণ কী?

২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডসে বেশ কিছু পাখি মারা যাওয়ার খবর প্রকাশ করেছিল একটি ডাচ সংবাদমাধ্যম। সে বছরের পহেলা নভেম্বর দেশটির দৈনিক আলগেমিন ডাগব্লাড (এডি) এর বরাতে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের হাইগেন্সপার্কে অন্তত ২৯৭টি পাখি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, “ইতিমধ্যে কারণ জানতে পাখিদের রক্ত পরীক্ষার জন্যে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষামূলক ফাইভ জি পরিচালনায় পাখিগুলো মারা গেছে– এমন কোনো দাবি সেই প্রতিবেদনে নেই।”

২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর এক ঘোষণায় পাখিদের মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে হাইগেন্সপার্কে ফাইভ জির কোনো পরীক্ষা হয়নি বলে উল্লেখ করেছে স্নোপস। নেদারল্যান্ডসের অ্যান্টেনা ব্যুরোর প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তারা বলেছে যে, ফাইভ জি রেডিয়েশনের কারণে পাখি মৃত্যুর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অ্যান্টেনা ব্যুরো মূলত দেশটির টেলিযোগাযোগ এন্টেনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দিয়ে থাকে।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক টেলিকমপেপারের বরাতে স্নোপস আরও লিখেছে, ২০১৮ সালের হাইগেন্সপার্কে একটি ফাইভ জি টেস্ট হয়েছিল তবে সেটি ছিল পাখি মারা যাওয়ার ঘটনার কয়েক মাস আগে, ২০১৮ সালের জুন মাসে।

ফাইভ জি নিয়ে আরো বেঠিক তথ্য

সম্প্রতি দ্য হেলদি ইন্ডিয়ান প্রজেক্ট ফাইভ জি ও তার রেডিয়েশন নিয়ে একটি যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ফাইভ জি রেডিয়েশনের কারণে করোনা হয় সংক্রান্ত দাবিকে বেঠিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে এ সংক্রান্ত অন্তত ৮টি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এএফপি ফ্যাক্টচেক। যার মধ্যে ফাইভ জির কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার মতো বিভ্রান্তিকর দাবিও যাচাই করা হয়েছে। এছাড়া ফাইভ জি সম্পর্কিত মিসইনফরমেশন নিয়ে ইউনিসেফের একটি ব্লগও রয়েছে। সেখানে নেদারল্যান্ডসের কয়েকশ পাখির মৃত্যুর পাশাপাশি ফাইভ জি ডায়াবেটিক ঘটায়– এমন দাবিও যাচাইয়ের মাধ্যমে ভুল প্রমাণ করেছে।

আরো কিছু লেখা