ডিসমিসল্যাব
কীভাবে বুঝবেন একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুব সম্ভবত মিথ্যা?
ডিসমিসল্যাব
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আছে সবখানে এবং তা হতে পারে যেকোনো বিষয়ে।
নানা কারণে মানুষ মিথ্যা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করে – এর মধ্যে কিছু আছে যা সত্যিকারের, যেমন স্যাকলার পরিবার বাস্তবেই লাভের আশায় অক্সিকন্টিনের আসক্তির বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করেছিল, যার কারণে (ড্রাগ ওভারডোজে) প্রাণ হারিয়েছিল অগুনতি আমেরিকান।
ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের চরম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে এবং সর্বশেষ ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে একজন বিক্ষোভকারীর মর্মান্তিক আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু সত্যিই যদি পৃথিবীতে কোনো অদৃশ্য শক্তির কারসাজি চলে, তাহলে একজন কীভাবে জানবে যে আসলে কী ঘটছে?
এখানেই আসে আমার গবেষণা; আমি (এইচ. কলিন সিনক্লেয়ার) একজন সামাজিক মনোবিজ্ঞানী, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ন্যারেটিভ নিয়ে অধ্যয়ন আমার কাজ। আপনার দেখা বা শোনা কোনো একটি দাবি কীভাবে যাচাই করবেন জেনে নিন।
ধাপ ১: প্রমাণ খুঁজে বের করুন
কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সত্যতা মিলেছে কারণ তার প্রমাণ ছিল। যেমন, ৯০ এর দশকে তামাক কোম্পানিগুলো সিগারেটের ক্ষতিকারক দিকটি জানত এবং তারপরও তারা মুনাফার আশায় বিষয়টি গোপন রেখেছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বেরিয়ে আসে তামাক ও ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে।
আদালতের মামলায় উদ্ঘাটিত কর্পোরেট নথিতে অভ্যন্তরীণ তথ্য থাকে, যা থেকে জানা যায় নির্বাহী কর্মকর্তারা কখন, কোন বিষয়গুলো আগেই জানতে পেরেছিলেন। এসব তথ্য গোপন করার অপচেষ্টার ঘটনা অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা প্রকাশ করেন। চিকিৎসকরা জানান কীভাবে এটি তাদের রোগীদের প্রভাবিত করেছে। সতর্ক করে অভ্যন্তরীণ হুইসেলব্লোয়াররাও।
কিন্তু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভিত্তিহীন হলে শক্ত প্রমাণের অভাব থাকে। বরং এতে এমন কিছু বিষয় থাকে যা সংশয়বাদীদের জন্য সতর্ক সংকেত হিসেবে কাজ করতে পারে:
- প্রমাণের আদি উৎসগুলো খারিজ করে দিয়ে সেগুলোকেও চক্রান্তের অংশ হিসেবে দাবি করা
- এমন দাবি করা যে কোনো তথ্য নেই, কারণ কেউ এটি লুকিয়ে রেখেছে, যদিও কোনো ঘটনার পরপরই সমস্ত তথ্য অনেক সময় পুরোপুরি জানা যায় না
- দৃশ্যমান অসঙ্গতিগুলোকে মিথ্যা বলে আক্রমণের লক্ষ্য করা
- অস্পষ্ট বিষয়গুলোকেও অতিরিক্ত ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা; যেমন উড়ন্ত একটি বস্তু অজ্ঞাত হতেই পারে, কিন্তু এটিকে এলিয়েন স্পেসশিপ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা, যা কিনা একেবারেই ভিন্ন জিনিস।
- বিভিন্ন উপাখ্যান শুনানো- বিশেষ করে অস্পষ্ট কারও নাম করে- যেমন ‘মানুষ বলছে’ অমুক কিংবা ‘আমার কাজিনের বন্ধু জানে’ এমন বলে প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো
- গোপন তথ্য জানার দাবি করা- যা কেবল গুটিকয়েক মানুষের কাছে রয়েছে এবং যা সকলের কাছে পরিষ্কার ও স্পষ্ট সেগুলো উপেক্ষা করা
ধাপ ২: অভিযোগ যাচাই করুন
একজন ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক সাধারণত শুধু সেসব প্রমাণ উপস্থাপন করেন, যা নিজেদের ধারণাকে সমর্থন করে। তারা খুব কমই যুক্তি, কার্যকারণ বা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা দিয়ে তাদের ধারণা যাচাই করে থাকেন।
তারা গবেষণা করেছেন বলেও দাবি করতে পারেন, তবে সেটি সাধারণত বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে হয় না। বিশেষ করে, তারা কখনোই নিজেদের ভুল যাচাই করার চেষ্টা করেন না।
একজন সংশয়বাদী বিজ্ঞানীদের পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা করতে পারেন: কোন প্রমাণ ব্যাখ্যাটির বিরোধিতা করবে, তা নিয়ে চিন্তা করবেন- এবং এরপর সেই প্রমাণাদি খোঁজার চেষ্টা করবেন।
এই প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে যে ব্যাখ্যাটি সঠিক ছিল, আবার উল্টোটাও হতে পারে। সে যাই হোক, একজন বিজ্ঞানীর মতো নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: আপনার উপলব্ধি ভুল ছিল তা বিশ্বাস করতে আপনাকে এখন কী করতে হবে?
ধাপ ৩: অতিরিক্ত জটিল তত্ত্ব থেকে সাবধান
যখন বিভিন্ন তত্ত্ব দাবি করে যে বৃহৎ গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে, তখন এটিকেও সতর্ক সংকেত হিসেবে নিতে হবে।
যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর সত্যতা থাকে সেগুলোর সঙ্গে সাধারণত ছোট ও বিচ্ছিন্ন শক্তি জড়িত থাকে, যেমন কোনো কোনো কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা কিংবা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এমনকি তামাক কোম্পানিগুলোর মধ্যেও ষড়যন্ত্রগুলো শুধু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যারা তাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বেতনভোগী বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
মিথ্যা ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো প্রায়শ বিশ্বনেতা, মূলধারার মিডিয়া, বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়, হলিউডের মতো বিনোদন সংস্থা এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মতো বৃহৎ গোষ্ঠীকে দায়ী করে।
ম্যাক্স আজারেলো, যিনি ২০২৪ সালের এপ্রিলে নিউ ইয়র্কের আদালতের বাইরে নিজের গায়ে আগুন দিয়েছিলেন, তিনি একটি অনলাইন ইশতেহার লিখেছিলেন। তিনি এতে বিল ক্লিনটন পরবর্তী সব রাষ্ট্রপতি, যৌন অপরাধী জেফরি এপস্টেইন এবং এমনকি “দ্য সিম্পসনস” এর লেখকদের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনেন।
মনে রাখবেন, যত বেশি লোক একটি গোপন বিষয় জানে, তাকে আড়াল রাখা তত কঠিন।
ধাপ ৪: উদ্দেশ্য কী হতে পারে তা সন্ধান করুন
কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সত্যি হলে একদল মানুষ কোন উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং কী লাভের আশা করেছিল, সেই ব্যাখ্যাও থাকে। ভুয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্বে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রশ্ন থাকে, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা তাতে কী লাভ করতে পারে, তা বিবেচনা করা হয় না। বিশেষ করে যদি লাভক্ষতির হিসাব করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ফিনল্যান্ডের অস্তিত্ব সম্পর্কে মিথ্যা বলে নাসা কী লাভ করবে?
বিশেষ সতর্ক হোন যখন কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে যারা প্রান্তিক, তাদের কোনো ‘এজেন্ডা’ রয়েছে এমন কিছু দাবি করা হয়। যেমন, ‘সমকামীদের এজেন্ডা’ বা ‘মুসলমানদের এজেন্ডা’।
এছাড়াও দেখুন যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো ছড়াচ্ছে, তাদের কোনো কিছু লাভ করার মতো আছে কি না। যেমন, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় টিকা নিয়ে ভুয়া দাবি ছড়ানোর সঙ্গে প্রাথমিকভাবে জড়িত ১২ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেছে। গবেষকরা দেখেছেন এই দাবিগুলো থেকে তাদের লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল।
ধাপ ৫: অভিযোগের উৎস সন্ধান করুন
আপনি যদি ষড়যন্ত্রের দাবির পিছনে কারা রয়েছে বা সেটি কোথা থেকে আসছে তা খুঁজে না পান তবে এটিও একটি সতর্ক সংকেত। কিছু মানুষ দাবি করতে পারে যে তাদের নিরাপত্তার জন্য তাদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে, না হলে ষড়যন্ত্রকারীরা তথ্য প্রকাশের দায়ে প্রতিশোধ নিতে পারে। কিন্তু এরপরও সাধারণত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মূল উৎস খুঁজে পাওয়া যায়- হতে পারে কোনো একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে, হোক সেটা বেনামে খোলা।
সময়ের সঙ্গে বেনামী উৎসগুলো সাধারণত সামনে আসে বা তাদের শনাক্ত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কারণে রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্ট পদ খোয়ান। কয়েক বছর পর ঘটনার সঙ্গে জড়িত ‘ডিপ থ্রোট’ নামের একজন ভেতরকার খবরদাতার পরিচয় সামনে আসে। তিনি ছিলেন ৭০ এর দশকের একজন উচ্চপদস্থ এফবিআই কর্মকর্তা মার্ক ফেল্ট।
এমনকি কিওএনন ষড়যন্ত্রের পিছনের “কিউ” কেও চিহ্নিত করা হয়েছে, আর সনাক্তকরণের কাজটি সরকারী তদন্তকারীরাও করেননি। আসলে ‘কিউ’ উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা ছিল না, যেমনটা কিছু মানুষ বিশ্বাস করত।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো হয় স্বচ্ছ।
ধাপ ৬: অতিপ্রাকৃত থেকে সাবধান
কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অলৌকিক, এলিয়েন, দানবীয় বা অন্যান্য অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে জড়িত- যদিও এগুলোর কোনোটাই প্রমাণিত নয়। যেমন, ৮০ ও ৯০ এর দশককে যারা দেখেছেন তাদের হয়তো মনে আছে শয়তানপূজারীরা শিশুদের নির্যাতন করছে ও বলি দিচ্ছে এমন দাবি তখন কী আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। সেসব দাবি কখনো পুরোপুরি দূর হয়নি।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে, সম্ভবত ‘ভি’ টিভি সিরিজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমেরিকানদের অনেকে টিকটিকি মানবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। ‘বিগফুট’ মিথে বিশ্বাস করে প্রমাণের আশায় বসে থাকাকে ঝুঁকিহীন মনে হতেই পারে! কিন্তু যে লোকটি ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর ন্যাশভিলে বোমা ফেলেছিল, দৃশ্যত তার ধারণা ছিল এতদিন টিকটিকি মানবেরা পৃথিবী শাসন করেছে।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর যত কাছাকাছি হয়, তার কল্পকাহিনী হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।
ধাপ ৭: অন্যান্য সতর্কতার দিকে লক্ষ্য রাখুন
আরও কিছু রেডফ্ল্যাগ রয়েছে। যেমন, পূর্বসংস্কারবশত কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা; যেমন, অ্যান্টিসিমেটিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।
আবার তত্ত্বে বিশ্বাসীরাও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্বাসগুলোকে বাস্তবেই বিচার না করে উলটো সন্দেহ পোষণকারীদেরই বোকা কিংবা এর সঙ্গে জড়িত দাবি করে খারিজ করে দেয়- সে যে-ই হোক না কেন।
সবশেষে, এ জাতীয় বিষয়ই ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোকে এতো আকর্ষণীয় করে তোলে। আসলে আপনি ভুল হতে পারেন এটা স্বীকার করার চেয়ে সমালোচনাকে উড়িয়ে দেওয়ার কাজটি বেশি সহজ।
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশন-এ। লেখক এইচ. কলিন সিনক্লেয়ার লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির সামাজিক মনোবিজ্ঞানের সহযোগী গবেষণা অধ্যাপক। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।