তৌহিদুল ইসলাম রাসো
যৌতুক চাওয়ায় বর ও বরের বাবাকে বেঁধে রাখার ভাইরাল ভিডিওটি সাজানো
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
যৌতুক চাওয়ায় বর ও বরের বাবাকে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে গ্রামবাসী- ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওটি সাজানো। সত্যি ঘটনা মনে করে গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ, গ্রুপ ও ব্যক্তিগত আইডি থেকে ভিডিওটি শেয়ার দেওয়া হয়েছে। এমনকি দৈনিক দৈনিক ইত্তেফাকের নিজস্ব পেজে রিল হিসেবে ভিডিওটি শেয়ার করে বলা হয়- ‘যৌতুক চাওয়ায় বর ও বরের বাবাকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছে মেয়ের পরিবার।’ ইত্তেফাকের পেজটি ভেরিফায়েড বা সত্যায়িত।
‘রিভার্স ইমেজ সার্চের’ মাধ্যমে ফেসবুকে ওয়ে টু জান্নাহ (Way to Jannah) নামক পেজে আসল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। গত ১২ এপ্রিলে শেয়ার করা রিল ও ভাইরাল হওয়া রিলটি হুবই একই। ফেসবুকের ওয়ে টু জান্নাহ পেজটি বিশ্লেষণে দেখা যায় তারা বিনোদনের উদ্দেশ্যে নানা ধরণের ভিডিও বানিয়ে শেয়ার করে থাকে। আলোচিত ভিডিওটির কথিত বরের বাবা ও তাকে মারতে উদ্যত হওয়া ব্যক্তিকে পেজটির আরো কিছু ভিডিওতে সনাক্ত করা গিয়েছে, পৃথক গল্প ও চরিত্রে।
সাজানো ভিডিওটি ইত্তেফাকের মতো মূলধারার গণমাধ্যমের নিজস্ব ফেসবুক পেজে আসায় সহজেই বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। এই যাচাই প্রতিবেদনটি লেখার সময় পর্যন্ত ইত্তেফাকের রিলটি প্রায় দুই হাজার ব্যবহারকারী শেয়ার করেন। আর লাইক প্রায় একুশ হাজার এবং মন্তব্য করেন প্রায় সতেরশ ব্যবহারকারী। ইত্তেফাকের রিলটি বিভিন্ন ফেসবুক পেজ (১, ২) ও ব্যক্তিগত প্রোফাইল (১, ২) থেকেও শেয়ার হতে দেখা যায়।
ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যাচ্ছে বরের পরিবার শুরুতে যৌতুক না চাইলেও কাবিনের সময় বরের বাবা গাড়ি চাইছেন। ভিডিওতে দুজন ব্যক্তিকে রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। তাদের পরিচয় হিসেবে বর ও বরের বাবা উল্লেখ করা হয়। ভিডিওর শেষে এক ব্যক্তিকে চড়া গলায় কিছু বলতেও শোনা যায়।
প্রকৃত ভিডিওটি বিনোদনের উদ্দেশ্যে বানানো হলেও তা ভিডিওর শুরুতে বা শেষে ‘ইন্ট্রো’ বা ‘আউটরো’ হিসেবে জানায়নি। নির্মাতারা বিষয়টি চেপে গেছেন ভিডিও পোস্ট করার সময়ও। ফলে সত্যি ঘটনা ধরে নিয়ে এটি শেয়ার করা হচ্ছে।
ঘটনাটিকে সত্যি মনে করে ভিডিও শেয়ার দেওয়া হয়েছে ফেসবুকের অনেক গ্রুপ (১, ২, ৩), পেজ (১, ২, ৩) ও আইডি (১, ২, ৩) থেকে। এছাড়া অনেক ফেসবুক পোস্টে (১, ২, ৩) কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভিডিওটি দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার একটি গ্রামের বলে শেয়ার করা হচ্ছে। ইউটিউবেও একই ধরণের একাধিক (১, ২, ৩) ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ওয়ে টু জান্নাহ পেজ বিশ্লেষণ
১২ এপ্রিল বেলা ১২টা ২০ মিনিট। ফেসবুকের রিলে কথিত বর ও তাঁর বাবাকে বেঁধে রাখা অবস্থায় দেখা যায়। ক্ষুব্ধ এক ব্যক্তি ছুটে গিয়ে কথিত বরের গায়ে হাত তোলেন।
১২ এপ্রিল দুপুর ১টা ০২ মিনিট। ফেসবুক রিলের দৃশ্যে দেখা যায় কথিত বর ও তাঁর বাবাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশে একজন বয়স্ক ব্যক্তি সম্ভবত মেয়ের বাবা পরিচয়ে উপস্থিত লোকজনকে বলছেন: ‘কুনু কথা নাই যৌতুক দেওয়ার। আজকে কাবিনের সময় ছেলের বাবা চাইতাছে: আমারে গাড়ি দেও। আমি গরীব মানুষ বাবা, আমি গাড়ি কইত্তে দেয়াম। আমার তো গাড়ি দেওয়ার মতো সমর্থ নাই।’
১৭ এপ্রিল বেলা ১১টা ২৩ মিনিট। পেজ থেকে লাইভ করা হয়। আগের ভিডিওতে যে ব্যক্তিকে মারমুখো হয়ে কথিত বর ও বরের বাবার দিকে তেড়ে যেতে দেখা গিয়েছিল এবার তাঁকে দেখা যায় শুটিং এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি দর্শকদের উদ্দেশ্য বলেন: ‘এইখানে একটা বিয়ার গেইট বানতাসি। আপনাদেরকে বিনুদন উপহার দেম। এই বিনুদনগুলো দেইক্যা আপনারা লাইক, শেয়ার কমেন্ট কইরা দিবেন।’
১৭ এপ্রিল দুপুর ২টা ২৩ মিনিট। ১২ তারিখের ভিডিওতে পাত্রের বাবা সাজানো ব্যক্তিটিকে ওরকম করেই পিছমোড়া করে বাঁধা হয়। ঘণ্টা তিনেক আগে যিনি লাইভে এসে বলেছিলেন, বিয়ার গেট বানতাসি, বিনুদন দেম, এবার তিনি বেঁধে রাখা ব্যক্তিটিকে মারার অভিনয় করেন। যাচাইয়ে দেখা যায়, ভাইরাল ভিডিওর কথিত ‘বরের বাবা’ ও ১৭ তারিখের ভিডিওর ‘বরের বাবা’ একই ব্যক্তি। তাঁর দুদিনের পোশাকও দেখা যায় হুবহু এক। লাইভে এসে যিনি বিনোদন ভিডিও বানানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন দুই ভিডিওতেই তাঁকে সনাক্ত করা গিয়েছে- যেখানে তিনি ছিলেন মারধরকারী ব্যক্তির ভূমিকায়।
কমেন্টে দুয়েকজনকে ভিডিওটি নিয়ে প্রশ্ন করতেও দেখা যায়। একজন লেখেন, ”এই যে একটা ভিডিও যৌতুক চাওয়াতে ছেলের বাবাকে বেঁধে রেখেছে মেয়ের পক্ষ ভিডিওটি মাত্র ১৯ সেকেন্ড কোথাকার ঘটনা অনেক জনকে জিজ্ঞেস করলাম কেউ জানে না শুধু পোস্টে করে যাচ্ছে!!!”
ফেসবুকে এই পেজটি তৈরি করা হয়েছে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। লাইকের সংখ্যা ৩৯৭ টি ও ফলোয়ার ৩২ হাজার। গত এক সপ্তাহেও তাদেরকে আরো কয়েকটি সাজানো ভিডিও আপ করতে দেখা গেছে। ১৮ এপ্রিল দুপুরে পোস্ট করা একটি সাজানো ভিডিওতে দেখা যায় কথিত ওই বরের বাবাকেই পরকিয়ার অভিযোগে এক নারীর সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। তবে পেজের বিবরণে ঘোষণা দেওয়া নেই যে তারা বিনোদনের জন্য সাজানো ভিডিও তৈরি করে থাকেন।