আহমেদ ইয়াসীর আবরার
কুমিল্লার মুরাদনগরের ভুক্তভোগী নারীর পরিচয়ে ছড়ানো হচ্ছে পুরোনো দুটি ভিডিও
আহমেদ ইয়াসীর আবরার
২৮ জুন রাতে কুমিল্লার মুরাদনগরে এক হিন্দু নারীকে মারধর ও ধর্ষণের অভিযোগে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুতই সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে ঘটনাটি। এরই মধ্যে ফেসবুকে আরও দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে সেগুলো ওই ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য। তবে যাচাইয়ে দেখা গেছে, দুটি ভিডিওই যথাক্রমে সাত ও নয় মাস পুরোনো এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
গত ২৮ জুন রাতে এক নারীকে মারধরের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ২৬ জুন রাতে মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর পাঁচকিত্তা গ্রামের ফজর আলী নামের এক ব্যক্তি এক নারীকে ধর্ষণ করার অভিযোগে এলাকার লোকজনের হাতে আটক ও প্রহৃত হন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কিছু লোক তাৎক্ষণিকভাবে ভিকটিমের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে ওই ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য দাবিতে দুটি ভুয়া ভিডিও ছড়াতে দেখা যায়।
নাটোরে ধর্ষণের অভিযোগকারী ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য কুমিল্লার বলে প্রচার
কুমিল্লার হিন্দু নারীর বক্তব্য দাবিতে ছড়ানো প্রথম ভিডিওতে (১, ২, ৩) এক নারীকে বলতে শোনা যায়, “আজ আমাকে ধর্ষণ করেছে, পরবর্তীতে আরেকটা করবে, … এইটা আমার মাইনা নেয়া অসম্ভব। ফাঁসি যদি না হয়, আমি এই মুহুর্তে মাইনা নিতে পারব না। যদি মাইনা নিতে না পারি, জামিন হয়ে চোখের সামনে আইসা ঘুইরে বেড়ায়, আমি বলেছি যে আমি এই জীবন রাখবো না, আমি নিজের জীবন নিজেকে শেষ করে দিব।”

ভিডিওর ক্যাপশনে বলা হয়,“কুমিল্লার ধর্ষণের শিকার আমাদের সাহসী বোনের অগ্নিঝরা বক্তব্য! মুরাদনগর, কুমিল্লা।” ভিডিওর মাঝে “কুমিল্লায় ধর্ষণের অভিযুক্ত আ.লীগ নেতাকে বিএনপি বানিয়ে অপপ্রচার” শিরোনামের ঢাকা টাইমসের একটি ফটোকার্ড আসে যেখানে সম্প্রতি ২৮ জুনের ঘটনায় অভিযুক্তের ছবিও দেখা যায়।
মূল ভিডিওটি খুঁজতে গেলে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর তারিখে সামাজিক মাধ্যম এক্সে পোস্ট হওয়া একটি ভিডিও। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়, “২৫ সেপ্টেম্বর রাতে, নাটোরের ছোট চৌগ্রামের হালদার পাড়া এলাকার স্বপ্না হালদার নামের একজন গৃহিণীকে ধর্ষণ করে স্থানীয় মুসলিম এবং বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম”। এই পোস্টে ভিডিওটির পূর্ণ সংস্করণ পাওয়া যায়।

এক্স পোস্টটির তথ্য ব্যবহার করে কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায় নিউজ২৪ এর। ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, “নাটোরের সিংড়ায় এক নারীর ঘরে ঢুকে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগ প্রতিবেশি যুবক রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। বুধবার ভোররাতে উপজেলার ছোট চৌগ্রামে ঘরে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে জোরপূর্বক ওই নারীকে ধর্ষণ করা হয় বলে জানা গেছে। অভিযুক্ত ধর্ষক ছোট চৌগ্রামের মৃত ফজলু বিশ্বাসের ছেলে।” অর্থাৎ, ভিডিওর অভিযোগকারী নারীর সঙ্গে সম্প্রতি কুমিল্লার মানিকনগরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।
কুমিল্লায় ভাইরাল ভিডিওর নারীর পরিচয়ে ছড়িয়েছে আরেক ভুক্তভোগীর ভিডিও
কুমিল্লায় ভাইরাল ভিডিওর ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য হিসেবে দ্বিতীয় আরেকটি ভিডিও ছড়াতে দেখা গেছে।
ভিডিওর ক্যাপশনে বলা হয়, “একটি অসহায় সংখ্যালঘু হিন্দু মেয়ের আর্তনাদ শুনুন!! উল্লেখ্য ২৭/৬/২০২৫ ইং, কুমিল্লার মুরাদনগরের “জয়নাল মোল্লা” নামের এই নেতা ক্ষমতার জোরে অসহায় হিন্দু মেয়েকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি ও নিপীড়ন করছে। বাকিটা ভুক্তভোগী বোনটির মুখে শুনুন। কি করতে চেয়েছিল এই জয়নাল মোল্লা নামের কু*লাঙ্গার। ঘটনাস্থল কুমিল্লা জেলা মুরাদনগর উপজেলা বাঙ্গরা বাজার থানা”।

একই ভিডিও ২৭ জুনের উল্লেখ করে একাধিক পোস্ট হতেও দেখা যায় (১, ২, ৩, ৪)। ভিডিওতে একজন নারীকে কথা বলতে দেখা যায়। ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য অনুযায়ী জয়নাল মোল্লা নামের একজন ব্যক্তি কর্তৃক তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এই ভিডিওটি খুঁজতে গুগলে কিওয়ার্ড সার্চ করে চলতি বছরের জুন মাসের ১ তারিখে ফেসবুকে পোস্ট হওয়া একটি ভিডিও পায় ডিসমিসল্যাব। ‘স্টার মুরাদনগর’ নামের একটি পেজ থেকে জুন ১ তারিখে পোস্ট হওয়া ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা “জয়নাল মোল্লা এই হিন্দু মেয়েটাকে কি করতে চেয়েছিল তার নিজ মুখ থেকে শুনুন -জয়নাল মোল্লা হচ্ছে মাসুদ গ্রুপের লোক বাংগরা থানা”।

ঘটনাটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে কিওয়ার্ড সার্চ করলে একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সামনে আসে ডিসমিসল্যাবের। ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে আমোদ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার এক নারীকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মুরাদনগর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব জয়নাল মোল্লার বিরুদ্ধে কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করা হয়।” গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জয়নাল মোল্লাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল।
অর্থাৎ, এই ভিডিওটির সঙ্গেও কুমিল্লার মুরাদনগরের সাম্প্রতিক ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।