ফাতেমা তাবাসুম
১৯৬৫’র সিনেমা-দৃশ্যকে আফ্রিকার আদিবাসীদের নরমাংসভোজ বলে দাবি
ফাতেমা তাবাসুম
আফ্রিকার আদিবাসীরা কীভাবে জীবিত মানুষকে খায় দেখুন- এমনই দাবিতে সম্প্রতি একটি রিল সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে ছড়াতে দেখা যায়। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওতে করা দাবিটি সত্য নয়। ১৯৬৫ সালের একটি সিনেমার দৃশ্য নিয়ে ভুয়া ফেসবুক রিলটি বানানো হয়েছে।
গত ২৫ জুন সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে এক ব্যবহারকারী একটি রিল পোস্ট করেন। ক্যাপশনে লেখা হয়: “আফ্রিকার আদিবাসীরা কীভাবে জীবিত মানুষকে খায় দেখুন।” রিলটিতে দেখা যায়, মানুষের মতোই দেখতে একটি অবয়বের সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে বাঁশ বা মোটা খড়ির সঙ্গে বাঁধা হয়েছে। একদল আদিবাসী বাঁশটিকে ঘুরিয়ে জ্বলন্ত আগুনে পোড়াচ্ছে, একই সঙ্গে উল্লাস করছে।
ভিডিওটির নেপথ্যে একজনকে বলতে শোনা যায়: “বন্ধুরা আফ্রিকার এই আদিবাসীরা কীভাবে জীবিত মানুষ খায় দেখুন। তারা প্রথমে মানুষটির পুরো শরীর কাঁদা দিয়ে মেখে নেয় এবং কিছুক্ষণ শক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। তারপর তারা মানুষটিকে গ্রিলের ওপর তোলে এবং তার সমস্ত শরীর সমানভাবে গরম করার জন্য লাঠি দিয়ে ঘোরাতে থাকে। ঐ মানুষটি যেন অল্প সময়ের মধ্যে না মরে তাই তারা তার মুখ এবং নাকের মধ্যে বায়ু চলাচলের জন্য একটি ঝিল্লি লাগিয়ে দেন। যাতে সে ধীরে ধীরে মরে এবং তার তাকে ধীরে ধীরে গ্রিল বানিয়ে খেতে পারে।” এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রিলটিতে সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, শেয়ার করেছেন ৩১৮ জন।
ডিসমিসল্যাব রিলটি থেকে স্থিরচিত্র নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ চালায়। যাচাইয়ে বেরিয়ে আসে দৃশ্যটি ১৯৬৫ সালের “দ্য ন্যাকেড প্রে” নামক একটি আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চারমূলক চলচ্চিত্রের। ছবিটি নির্মাণ ও সহ-প্রযোজনা করেন কর্নেল ওয়াইল্ড, যিনি নিজেই এ সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ছবিটির দৃশ্যধারণ হয় দক্ষিণ আফ্রিকার পাহাড় ঘেরা তৃণভূমিতে। সিনেমার প্রেক্ষাপট মূলত প্রধান চরিত্রের টিকে থাকার কাহিনী নিয়ে। উক্ত সিনেমায় তিনি একজন সাফারি গাইড।
চলচ্চিত্রটির যে অংশ দিয়ে ফেসবুক রিল বানানো হয়েছে তাও ‘ক্যানিবালিজম’ বা ‘মানুষ পুড়িয়ে খাওয়ার দৃশ্য’ নয়। সিনেমাটির কয়েকটি খুনের মাঝে এটি ছিল এক খুনের দৃশ্য; একজন জীবিত মানুষকে হাত-পা বেঁধে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য বা কল্পকাহিনী। তবে এখানে মানুষকে খাওয়া বা ক্যানিবালিজমের কোনো চর্চা দেখানো হয় না। তাই এই দৃশ্য ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট আদিবাসীদের ক্যানিবালিজম চর্চা বা মানুষের মাংস খাওয়ার যে দাবি, তা সত্য নয়।
নরমাংসভোজ দাবিতে অপতথ্য ছড়ানোর ঘটনা নতুন নয়। গত মে মাসে হাইতিতে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে দাবি করা হয়, ঘটনাটি ‘হাইতিয়ান ক্যানিবালিজম’ এর বড় প্রমাণ। ‘হাইতিয়ানদের একটি দল আস্ত একটা মানুষকে সিদ্ধ করে খেয়েছে’ দাবি করে পোস্টে লেখা হয়: “এখন আপনি বুঝতে পেরেছেন কেন ডোমিনিকানরা তাদের সীমান্ত বন্ধ রাখতে চায়।” এরপর লিড স্টোরিজ তাদের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলে, ভিডিওটি ২০২৪ সালের নয়, নরমাংস ভোজের দাবিটিও ভিত্তিহীন। আসলে ২০১৮ সালে নাইজেরিয়ার ওমামবালা চলচ্চিত্রের ভিডিও ধারণস্থলে সাজানো উপকরণ ও স্পেশাল ইফেক্ট দিয়ে মজার ছলে বানানো হয়েছিল এটি। ভিডিওতে সিনেমাটির সেট ও প্রপ ম্যানেজারকেও দেখা যায়। একই বছর ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ ক্যামেরুনের কিছু গণমাধ্যমে “ক্যামেরুন: বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলে নরখাদকের দৃশ্য” দাবিতে প্রচারিত হয়। একই দাবিতে ক্যামেরুনের একজন মন্ত্রী সাক্ষাৎকারে বলেন, ক্যামেরুনের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলে নরমাংস ভোজের চর্চা চলে। এরপর “দ্য অবজার্ভার” এবং ক্যামেরুনের একটি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান স্টপব্লাব্লাক্যাম পৃথক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে জানায়, ভিডিওটি বাস্তব ঘটনাভিত্তিক নয়; এটি সিনেমার সেটে বানানো হয়েছে।
গত মার্চে এক্সে (সাবেক টুইটার) একই রকম একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান স্নোপস একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, হাইতির দুইজন পুরুষের মৃতদেহ প্রকাশ্য আগুনে ঝলসানোর ভয়ঙ্কর ফুটেজটি নিয়ে করা দাবি বিভ্রান্তিকর। ভিডিওর দাবিটি ছিল “হাইতিতে, গৃহযুদ্ধ চলছে, এবং ক্যানিবালিজম ফিরেছে।”
স্নোপস জানায়, ভিডিও ফুটেজটি ছিল মূলত ২০১৮ সালের চীনের ঝুহায়ে চিমেলং ওশেন কিংডম থিম পার্ক রেস্তোরাঁর হ্যালোইন উৎসবের জন্য বানানো একটি পার্টির ডেকোরেশনের। চীনা ভাষার সংবাদপত্র সিন চিউ ডেইলি ২০২০ সালে এই ভাইরাল ভিডিওর একটি স্থিরচিত্রসহ নিবন্ধ প্রকাশ করে। “আফ্রিকান রেস্তোরাঁ নিষিদ্ধ হচ্ছে মানুষের মাংস ভুনার জন্য? যা মূলত একটি হ্যালোইন উৎসবের ডেকোরেশন”– শিরোনামের এ নিবন্ধে বলা হয় চীনের ফুটেজ ব্যবহার করে ‘ক্যানিবালিজম’ চর্চার মিথ্যা দাবি করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষণা ব্যবস্থাপক ডেভান হ্যাঙ্কারসন মাদ্রিগাল “অপতথ্য যখন ‘জাতিগত’ হয়ে ওঠে” শীর্ষক প্রতিবেদনে এবিসি নিউজকে বলেন “বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অপব্যবহারের মাধ্যমে জাতিগত, লিঙ্গভিত্তিক ও অন্যান্য পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে” এ ধরনের অপতথ্য সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। এর মূলে বর্ণবাদ এবং কুসংস্কার কাজ করে বলে মনে করেন মাদ্রিগাল।