ফাতেমা তাবাসুম
ভারতে ৬৮ হাজার বাংলাদেশি নারী পাচারের অপতথ্য ছড়িয়ে ভুয়া ফটোকার্ড
ফাতেমা তাবাসুম
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে কয়েকদিন ধরে একাধিক গণমাধ্যমের নামে কিছু ফটোকার্ড প্রচারিত হতে দেখা গেছে যেখানে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার নারীকে ভারতের যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে। পাচার হওয়া বাংলাদেশি নারীর সংখ্যা ১৪ হাজার- গণমাধ্যমেরই বরাত দিয়ে এমন দাবিও করা হচ্ছে। দাবিকৃত গণমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেজ যাচাই করে দেখা গেছে, তারা এমন কোনো ফটোকার্ড প্রচার করেনি। বিবিসি বাংলার ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি খবরকে বিভ্রান্তিকরভাবে বিভিন্ন সংখ্যাসমেত প্রচার করা হচ্ছে।
ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভারতসহ আরো অনেক দেশের নারী মিলিয়ে দেশটিতে মোট ১৪ হাজার নারী পাচারের শিকার। এদের মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছেন ৪০০ -এর মতো। লাগামহীনভাবে ছড়িয়ে পড়া এই ফটোকার্ডগুলিতে ৪০০ সংখ্যাটিকে ১৭০গুণ বাড়িয়ে লেখা হয়েছে “৬৮ হাজার” বাংলাদেশি নারীকে ভারতে পাচার করে যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে।
ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ডগুলোয় (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০) যমুনা ও সময় টিভি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলার নাম ব্যবহার করতে দেখা যায়। ফটোকার্ড ছাড়া শুধু টেক্সট পোস্ট দিয়েও (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০) অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। মূলত গত ২১ এপ্রিল থেকে এ জাতীয় পোস্ট সামনে আসছে।
ডিসমিসল্যাব ফটোকার্ডের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিবিসি বাংলায় ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পায়- যার শিরোনাম ছিল, “ভারতে পাচারের শিকার ১৪ হাজার নারীকে দিয়ে যেভাবে চলছিল যৌন ব্যবসা”। প্রতিবেদনটির শিরোনামে আদৌ বাংলাদেশ নেই। এছাড়া ভেতরে একেবারেই স্পষ্ট করে বলা আছে যে, এই ১৪ হাজারের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা হবে চার শ’র মতো। বিবিসি স্পষ্ট করেই বলেছে যে, বাংলাদেশ, নেপাল, থাইল্যান্ড এমনকি রাশিয়া ও উজবেকিস্তান থেকে নারীদের ভারতে পাচার করা হচ্ছে। ভারতের হায়দ্রাবাদ আর সাইবারাবাদকেন্দ্রিক একটি চক্র সামাজিক মাধ্যম, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ছাড়াও বিভিন্ন উপায়ে এই অপকর্ম করছে। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক প্রভৃতি স্থানীয় রাজ্যের নারীদেরও এই ১৪ হাজারের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
সাইবারাবাদ পুলিশের অপরাধ দমন শাখার প্রধান কভিথা দারা বিবিসিকে তখন জানিয়েছিলেন, ১৪ হাজারের বেশি নারীর মধ্যে বালাদেশি নারীর সংখ্যা চারশোর কাছাকাছি। এছাড়া তিনি আরো জানান, এই মোট সংখ্যার অন্তত অর্ধেক ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা এবং তাদের সকলকে উদ্ধার করা যায়নি।
শুধু বিবিসি বাংলা নয়, সংখ্যা জালিয়াতি করা হয়েছে যমুনা এবং সময় টিভির নামে ফটোকার্ডেও। দুটো মিডিয়ার নিজস্ব ফেসবুক পেজে বিভিন্নভাবে সার্চ করে এমন কোনো ফটোকার্ড পাওয়া যায়নি। দুটো মিডিয়া কখনোই এমন সংবাদ প্রতিবেদন করেনি যে ভারতে পাচার হওয়া বাংলাদেশি নারীর সংখ্যা ৬৮ হাজার। যাচাইয়ে দেখা যায়, ভারতে বাংলাদেশের নারী ও শিশু পাচারের বেশ কিছু সংবাদ প্রতিবেদন তারা বিভিন্ন সময় করেছে।
খবরটিকে ভিত্তি করে সংখ্যার অতিরঞ্জন কেবল নয়, জুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এক ব্যবহারকারী যমুনা টেলিভিশনের নামে বানানো ফটোকার্ডটির সূত্র উল্লেখ করে তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেনঃ “ধারণা করা যাচ্ছে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেত্রীদের পাচার করা হচ্ছে।”
আরেক ব্যবহারকারী একই অপতথ্য পোস্ট করে সঙ্গে ঢালাওভাবে লিখেন, “এটা নিয়ে দেশ, দেশের মানুষ, সরকার বা সাংবাদিক, প্রশাসন কোনো মাথা ঘামাচ্ছে না… সবগুলো নারী ছিলো মুসলিম, বুরখা হিজাব পড়া।” এই নেটিজেন তার বক্তব্যের সত্যতার পক্ষে কোনোই তথ্যসুত্র দেননি।
একই রকম পোস্ট শেয়ার করে আরেক ব্যবহারকারী লিখেনঃ “বাঙলাদেশের ৬৮ হাজার মুসলিম নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে। এই নিউজ কয়েকটা চ্যানেল থেকে দেখলাম। কিছুদিন আগে ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে ৩ লাখ মুসলিম নারীকে ভারতে পাচার করা হয়েছে একটা নিউজ দেখি৷”
একই রকম পোস্ট শেয়ার করে আরেক ব্যবহারকারী লিখেনঃ “বাঙলাদেশের ৬৮ হাজার মুসলিম নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে। এই নিউজ কয়েকটা চ্যানেল থেকে দেখলাম। কিছুদিন আগে ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে ৩ লাখ মুসলিম নারীকে ভারতে পাচার করা হয়েছে একটা নিউজ দেখি৷” ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, সাম্প্রতিককালে কোনো খবর মাধ্যম এমন নিউজ করেনি, ইউনিসেফেও এমন কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি)– এর “বাংলাদেশঃ অধ্যাপক জাকির হসেনের সাথে মানবপাচার প্রসঙ্গে সাক্ষাতকার” শীর্ষক ২০০৯ সালে পাবলিশ করা একটি সাক্ষাতকার খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে তিনি ইউনিসেফ এর একটি প্রতিবেদনের সমীক্ষার উল্লেখ করে বলেন, “বাংলাদেশে প্রতি মাসে প্রায় ৪০০ নারী ও শিশু পাচারের শিকার হচ্ছে।” এরপরে তিনি অন্য একটি সমীক্ষার তথ্য দিয়ে উল্লেখ করেন, যে সেসময় বিগত দশ বছরে ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়েছে। এই একই তথ্যসহ পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু নিবন্ধ খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। যার মাঝে দ্য ডেইলি স্টারে ২০১০ সালে প্রকাশ পাওয়া “নারী পাচার” শীর্ষক প্রতিবেদন একটি।