ফামীম আহমেদ
আসল চোখ, নকল চোখ
ফামীম আহমেদ
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে মানুষের চোখের একটি ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, ছবিটি ম্যাক্রো লেন্স দিয়ে তোলা। অর্থাৎ দাবি করা হচ্ছে, ক্যামেরায় তোলা মানুষের বাস্তব চোখের ছবি এটি। কিন্তু যাচাই করে দেখা গেছে, ছবিটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা, বাস্তব চোখের নয়।
গত ১৩ অক্টোবর, “মনোবিজ্ঞান(বিজ্ঞানের মজার সব তথ্য)” নামের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপে এটি পোস্ট করা হয়। ক্যাপশন দেওয়া হয়: “ম্যাক্রো লেন্স দিয়ে তোলা মানুষের চোখ সুবাহানাল্লাহ”। এই দাবিটি বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপে (১, ২, ৩) ও ইসলামিক গ্রুপে (১, ২, ৩ ) ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও কিছু শিক্ষা বিষয়ক গ্রুপেও (১, ২, ৩) এটি ভাইরাল হয়েছে। ডিসেম্বর মাসেও দাবিটি ফেসবুকে ছড়াতে দেখা গেছে। সামাজিক মাধ্যমে খোঁজ চালিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে একই দাবি সংক্রান্ত দেড়শো’র কাছাকাছি পোস্ট পাওয়া যায়। (১, ২, ৩)
যাচাইয়ের জন্য রিভার্স ইমেজ সার্চ করতে গিয়ে একই ছবি পাওয়া যায় সিজি সোসাইটি নামের একটি সাইটে। সেখানে ছবিটি প্রথম পোস্ট করেন জেনিয়া ফিলিমোনোভ নামের একজন ব্যবহারকারী। ‘রিয়েলিস্টিক আইজ’ ক্যাপশনের এই ছবি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয় ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল। জেনিয়া এই উদ্যোগের সহযোগী হিসেবে ‘রোমান লুভিজিন’ নামে আরেকজনের নাম উল্লেখ করেন।
সিজি সোসাইটির ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে: এটি মূলত পেশাদার ডিজিটাল আর্টিস্টদের একটি নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম। “আর্টস্টেশন” নামে ডিজিটাল আর্টিস্টদের আরেকটি প্ল্যাটফর্মেও ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে ‘ইউজিন ফিলিমোনোভ’ নামের আইডি থেকে একই চোখের ছবি পোস্ট করা হয়। সেখানেও একইভাবে রোমান লুভিজিন সহ-শিল্পী হিসেবে উল্লেখ করে ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে।
ইউজিনের প্রোফাইলে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ইউজিন ১৪ বছর ধরে কম্পিউটার-ভিত্তিক গ্রাফিক্স ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন। ইউজিনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটেও একই ছবি পাওয়া যায়। সেখানেও সহযোগী হিসেবে রোমান লুভিজিনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং এছাড়া ছবিটি তৈরির পেছনের ঘটনা ও পদ্ধতিও বর্ণনা করা হয়েছে।
মূলত চোখের এই ছবিটি ২০১৬ সাল থেকে ইউজিন ও রোমান দুইজন আর্টিস্ট মিলে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করেছেন। ছবিটির ব্যাপারে আরো জানতে ইউজিন ফিলিমোনোভের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া ইমেইলে তার সাথে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। তিনি জানান, “আমরা দুজন নিজেরাই এটি তৈরি করেছি। এটি বাস্তব কোনো চোখের ছবি নয়”।
উল্লেখ্য, কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই ছবিটিকে ‘ফাউন্ড্রি’ নামের একটি ভিজ্যুয়াল কোম্পানী তাদের ২০১৯ সালের ‘হল অব ফেইম’-এ জায়গা দিয়েছিল।
এই দাবির উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের দুইটি পোস্ট পাওয়া যায়। ২০১৯ এর ছবিতে সুরেন মানভেলয়ান নামক আর্মেনিয়ান একজন ফটোগ্রাফারের নাম পাওয়া যায়। তার ম্যাক্রোফটোগ্রাফিতেই ফুটে উঠেছে কাছ থেকে তোলা মানুষের চোখের ছবি। আর এই ছবি তোলার প্রজেক্টের নাম “ইউর বিউটিফুল আইজ”। এই প্রজেক্টের একটি ছবির সাথে ফিলিমোনোভের ছবিটির দারুণ মিল রয়েছে। ফিলিমোনোভের ছবিটি সুরেন মানভেলয়ানের ছবি বলে দাবি করেও কিছু পোস্ট (১,২, ৩) ভিয়েতনামে ছড়িয়েছে। ছবিটি নিয়ে বাংলাদেশসহ আরবি ও তুর্কি ভাষায় এ সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
সিজিআই বা কম্পিউটার জেনেরেটেড ইমেজ মূলত কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে বানানো কৃত্রিম ছবি। এটি এক ধরনের ডিজিটাল শিল্প। চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন ও ডকুমেন্টারিতে এ ধরনের ছবি এখন হরহামেশাই ব্যবহার করা হয়।
২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার জন্য ৭০৭ জন অংশগ্রহণকারীকে দেখানো হয়েছিল পাঁচটি আসল ও পাঁচটি নকল ছবি। সেখানে দেখা যায়: ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণকারীরা কারসাজি করা ছবিকে আসল বলে চিহ্নিত করেছেন। সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ঘিরেও ছড়িয়েছে এ ধরনের কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ ও অ্যানিমেশন।