আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ভিডিওটি ভুয়া, যাচাই হয়েছে, তবু ছড়াচ্ছে

ড. ইউনূসকে প্রশংসা করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য

ভিডিওটি ভুয়া, যাচাই হয়েছে, তবু ছড়াচ্ছে

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প– এমন দাবিতে একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, ট্রাম্প এমন কোন বক্তব্য দেননি এবং প্রচারিত ভিডিওটিতে যে অডিও যুক্ত করা হয়েছে, তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি।

গতকাল ১১ মে, আমার দেশ নামের একটি পেজ থেকে ভিডিওটি ব্যাপক ভাবে ছড়ায়। তবে ডিসমিসল‍্যবের যাচাইয়ে দেখা যায়, পেজটি নকল; আমার দেশ পত্রিকার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, এবং পেজটি এর আগেও ভুয়া খবর ছড়িয়ে‌ছে। তারা পরে পোস্টটি সরিয়ে নেয়।

গত রাতেই রিউমর স্ক‍্যনার এবং পরে ফ‍্যাক্টওয়াচ আলাদাভাবে যাচাই করে জানায়, ভিডিওটি পুরনো এবং তাতে ট্রাম্পের যে কন্ঠ ও বক্তব‍্য তা এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। 

নকল আমার দেশ পেজের সেই পোস্টে বলা হয়, “ড. ইউনূসের প্রশংসা করলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।” তাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলতে শোনা যায়, “ইউনুস আমার বন্ধু এবং তিনি অত্যন্ত উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক।”

তিনি আরো বলেন, “প্রফেসর ড. ইউনূস একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং তিনি আমার বন্ধুও। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন এবং তিনি খুব ভাল করছেন। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধিশালী করতে ড. ইউনূস বড় ভূমিকা রাখবেন।”

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকেও এই পোস্টটি শেয়ার করতে দেখা যায়। যদিও পরবর্তীতে পেজটি পোস্ট সরিয়ে নেয় এবং আসিফ নজরুলের শেয়ার করা পোস্টটিও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তবে একই দাবিতে ভিডিওটি ফেসবুকের বিভিন্ন প্রোফাইল ও গ্রুপ থেকে (, , , , ) পোস্ট হতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া এক্স এবং ইনস্টাগ্রামেও (, , ) ভিডিওটি পোস্ট হতে দেখা গেছে।

ভিডিওটির সূত্র যাচাই করতে গেলে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজের প্রকাশিত একটি ভিডিও ক্লিপ। ফক্স নিউজের এক্স, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে এই ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। পোস্টগুলোর ক্যাপশনে লেখা, “ট্রাম্প: পূর্বে কেউ কখনও পাবলিক ক্যাবিনেট মিটিং করেনি। তারা চুপ ছিল— কারণ তারা ইম্প্রেসিভ ছিল না।”  

ফক্স নিউজে প্রকাশিত এই ভিডিওটির সঙ্গে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির হুবহু মিল পাওয়া যায়।  সেখানে, ড. ইউনূসকে নিয়ে কোনো মন্তব্য ছিল না।

মূল ভিডিওটি, গত ৩০ এপ্রিল, ট্রাম্পের মন্ত্রিপরিষদ সভার। হোয়াইট হাউজের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল সেদিনই এটি সরাসরি সম্প্রচার করেছে এবং সেই চ‍্যানেলে দুই ঘন্টার পুরো ভিডিও রয়েছে। 

ভিডিওটির শিরোনাম ছিল “একটি ক্যাবিনেট মিটিং এ অংশগ্রহণ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, এপ্রিল. ৩০, ২০২৫।” সেখানে সভায় যোগ দেওয়া প্রত‍্যেকের সামনে লাল ও কালো রঙের “গালফ অব আমেরিকা ক্যাপ” সাজানো ছিল। বাংলাদেশে ছড়ানো ভুয়া ভিডিওতেও এই টুপি দেখা যায়। 

চলতি বছরের ২০ জানুয়ারিতে শপথ গ্রহণের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট অন্তত চারটি ক্যাবিনেট সভা করেছেন (, , , )। এদের কোনোটিতেই ‘বাংলাদেশ’ বা ‘ইউনূস’ সংক্রান্ত কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এবং শুধু ৩০ এপ্রিলের সভাতেই টুপিগুলো এভাবে সাজানো ছিল।

সর্বশেষ ক‍্যাবিনেট সভার ট্রান্সক্রিপ্ট বা লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় রোল কলের ওয়েবসাইটে। পুরো ট্রান্সক্রিপ্টে ড. ইউনূসকে নিয়ে এমন কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ফক্স টিভির যে অংশ থেকে নিয়ে যে ভুয়া ভিডিওটি বানানো হয়েছে, তা সভার ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট ২ সেকেন্ড থেকে ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময়ের থেকে নেওয়া। আসল ভিডিওর সঙ্গে ভুয়া অডিও জুড়ে দিয়ে সেটি বাংলাদেশে ছড়ানো হয়।

 বাংলাদেশি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্ট-ওয়াচের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ট্রাম্পের এই বক্তব্যটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে। এআই ডিটেকশন টুল ‘ডিপফেক ও মিটার’ দিয়ে অডিওটি যাচাই করে তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়।

আমার দেশ” নামের যে পেজ থেকে ভিডিওটি বেশি ছড়ায় সেটি প্রোফাইল এবং কভারে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম আমার দেশের লোগো ব্যবহার করেছে। তবে আমার দেশ পত্রিকার অফিসিয়াল পেজ থেকে জানানো হয় যে আসিফ নজরুলের শেয়ার করা পোস্টটি তাদের নয়।

আর ভুয়া ‘আমার দেশ’ পেজটির মাত্র ২০টি পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার মধ‍্যে অন্তত তিনটি ভুয়া: একটি হলো ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা ও এনসিপি নেত্রী তাসনুভা জাবিনের ভুয়া টকশো, দ্বিতীয়টি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আজম রনির গ্রেপ্তারের ভুয়া ভিডিও, এবং তৃতীয়টি পাকিস্তান বিমান বাহিনীকে কিং অব দ‍্য স্কাইজ বা আকাশের রাজা অভিহিত করা ভুয়া খবর। 

বিশ্লেষণ করা ২০টি পোস্টের মধ্যে ৪টি আওয়ামী লীগ ও ৪টি বিএনপির প্রতি বিরূপ এবং ৩টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের প্রতি আক্রমনাত্মক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাওয়া নিয়ে একটি সাম্প্রতিক পোস্টের জন্য অনলাইনে তোপের মুখে পড়েন মাহফুজ।

আরো কিছু লেখা