তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব
রাজশাহী এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর নয়
This article is more than 1 year old

রাজশাহী এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর নয়

তামারা ইয়াসমীন তমা
রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশি সম্প্রচার মাধ্যম একাত্তর টেলিভিশন গত ১৯ মার্চ রাজশাহীকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর দাবি করে একটি সংবাদ প্রচার করে। বক্তব্যের পক্ষে প্রতিবেদনটিতে কোনো সূত্র বা গবেষণার বরাত দেয়া হয়নি। কিন্তু এরপর রাতারাতি খবরটি টেক্সট ও গ্রাফিক্স পোস্ট আকারে সামাজিক মাধ্যমে (, , , ) ছড়িয়ে পড়ে। ২০ মার্চ দৈনিক যুগান্তরও তাদের ফেসবুক পেজে রাজশাহীকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর দাবি করে একটি গ্রাফিক্স প্রকাশ করে।

কিন্তু যাচাই করে দেখা গেছে, বিশ্বের পরিচ্ছন্ন শহরগুলোর যে নানা রকম তালিকা ও সূচক রয়েছে, তার কোনোটিতেই রাজশাহীর নাম নেই। ২০১৬ সালের একাধিক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় বাতাসে দূষিত কণা কমানোর ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্বে সবচেয়ে ভালো করেছে, তবে প্রতিবেদনটির অর্থ এই নয় যে এশিয়ার শহর বা নগরগুলোর মধ্যে রাজশাহীর বাতাসে দূষিত কণা সবচেয়ে কম। বরং সুইস প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে রাজশাহীর বাতাসকে “অস্বাস্থ্যকর” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং এই ইনডেক্সে এশিয়ার অনেক শহর বা নগরী রয়েছে যাদের বাতাসের মান রাজশাহীর চেয়ে ভালো। 

খবর ও সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্য 

একাত্তর টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে “এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর রাজশাহী” শিরোনামের ভিডিও প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণে দেখা যায় শুরুর ২০ সেকেন্ডে উপস্থাপিকা বলেন, “রাজধানী ঢাকা যখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তখন রাজশাহী শহর মর্যাদা পাচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে। দূষণ, যানজট জলজট আর মশার উপদ্রববিহীন সবুজ নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী। মেয়র জানালেন তার কিছু ভিন্নধর্মী উদ্যোগ ও নগরবাসীর সহযোগিতায় দেশের সেরা শহরে রূপ নিয়েছে রাজশাহী”।

তবে রাজশাহীকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরের মর্যাদা কারা দিচ্ছে তার কোনো উল্লেখ প্রতিবেদনটিতে নেই। এমনকি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বক্তব্যেও (এক মিনিট ৭ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট ২৭ সেকেন্ড এবং দুই মিনিট ৪৯ সেকেন্ড থেকে ৩ মিনিট ২৫ সেকেন্ড অংশে) এরকম কোনো তথ্য মিলে না। অর্থাৎ, শুধুমাত্র সংবাদ শিরোনামে ও উপস্থাপিকার বক্তব্যে এমন দাবি উঠেছে।

কিন্তু সংবাদটি প্রচারিত হতেই রাজশাহী এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরের খেতাব পেয়েছে– এমন দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। একাত্তর টিভির সূত্র দিয়ে অনেকে পোস্ট শেয়ার করেন। ফলে দ্রুত তা বিভিন্ন গ্রুপেও ভাইরাল হয়। যুগান্তর পত্রিকা এ বিষয়ে সংবাদ না করলেও ফেসবুকে একটি গ্রাফিক্স পোস্ট করে।

ভুল দাবি খণ্ডন

এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর বা নগরী নিয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের কোনো সাম্প্রতিক তালিকা বা গবেষণা পাওয়া যায় না। জাপান-ভিত্তিক মোরি মেমোরিয়ান ফাউন্ডেশনস ইনস্টিটিউট ফর আরবান স্ট্র‌্যাটেজি, ২০২২ সালে যে গ্লোবাল পাওয়ার সিটি ইনডেক্স (জিপিসিআই) প্রকাশ করে তাতে রাজশাহী বা বাংলাদেশের কোনো শহরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। 

এতে ছয়টি সূচক রয়েছে, যার মধ্যে পরিবেশ সূচকে কোনো শহর কতটুকু টেকসই, বাতাসের মান ও স্বাচ্ছন্দ্য এবং শহুরে পরিবেশ কেমন এই বিষয়গুলো যাচাই করা হয়। এক্ষেত্রে নির্দেশক হিসেবে জলবায়ু উদ্যোগ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ, বাতাসের মান, তাপমাত্রা, পানির মান, শহুরে বনায়ন ইত্যাদি বিষয়ও বিশ্লেষণ করা হয়। এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে সুইডেনের স্টকহোম। শীর্ষ ২০ শহরের তালিকায় এশিয়ার বিভিন্ন শহরের মধ্যে ১২, ১৩ ও ১৪তম অবস্থানে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, টোকিও, সিউল এবং ১৯-এ তাইপের নাম পাওয়া যায়।

পরিচ্ছন্নতা বা পরিস্কার নগরীর সঙ্গে রাজশাহীর একটি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় ২০১৬ সালে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে। এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ২০১৫ সালে বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বাতাসের কণাগুলো সরাতে বাংলাদেশের রাজশাহীর সফলতা সবচেয়ে বেশি। এই হিসাবটিও শুধু এশিয়া নয়, সমগ্র বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় করা হয়েছিল।

গার্ডিয়ানের এই প্রতিবেদনে এটা বলা হয়নি যে রাজশাহীর বাতাসে দূষিত কণার (পিএম১০) উপস্থিতি সবচেয়ে কম, বরং বলা হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য নগরীর তুলনায় রাজশাহীতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বায়ূকণা কমিয়ে আনার হার সবচেয়ে ভালো। তা-ও সেটি ২০১৬ সালের কথা।

আবহাওয়াগত তথ্যের নির্ভরযোগ্য সাইট মার্কিন আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থা অ্যাক্যু ওয়েদারের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রতিবেদন লেখার সময় রাজশাহীর বাতাসে সেই ক্ষতিকর পিএম১০ কণার পরিমাণ ছিল ৬২ মাইক্রোগ্রাম/ ঘন মিটার। একই সময় এশিয়ার আরো দুটি শহর ইরানের আহভাজ ও চীনের পানঝিহুয়ায় বাতাসে একই কণার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩৮ ও ৭ মাইক্রোগ্রাম/ ঘনমিটার। একই সময় ভারতের দিল্লি, পানাজি ও তেজপুরে পিএম১০ কণার পরিমাণ ৩৯, ৪২ ও ১০ মাইক্রোগ্রাম/ ঘনমিটার। অর্থাৎ, রাজশাহীর চেয়ে এশিয়ার এই শহরগুলোর বাতাসের মান ভালো।

গোটা বিশ্বেই কোন নগরী কতটা “ক্লিন” বা পরিচ্ছন্ন তার অন্যতম প্রধান নির্দেশক হলো বাতাসের দূষিত কণার উপস্থিতি। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আইকিউএয়ার নিয়মিতভাবে বিভিন্ন শহরে বাতাসের মানের তথ্য দিয়ে থাকে। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তালিকার সাথে মিলিয়ে এশিয়ার তিনটি শহরের বাতাস কতটা পরিস্কার তার তুলনা করে দেখা যায়, দূষণ কমিয়ে আনায় যেসব শহর ভালো করেছে, তাদের মধ্যে রাজশাহীর বাতাসে (পিএম ২.৫) দূষিত কণার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। এবং এখানে রাজশাহীর বাতাসকে “অস্বাস্থ্যকর” বলে উল্লেখ করা হয়।  

এশিয়া নয়, যদি কেবল বাংলাদেশের দিকে তাকানো যায় সেখানেও রাজশাহীকে সেরা বলার মত তথ্য পাওয়া যায় না। গত ২০ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকাশিত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুসারে রাজশাহীর রেকর্ডেড একিউআই ১৭৯, যা বাতাসের মান অনুসারে অস্বাস্থ্যকর। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রামের চেয়েও রাজশাহীর একিউআই মান ছিল বেশি, অর্থাৎ, এই দুটি শহরের চেয়ে রাজশাহীর বাতাসের অবস্থা খারাপ। 

বাতাস ছাড়া বসবাসের পরিবেশের অন্যান্য সূচকগুলোর দিকে তাকালেও রাজশাহীকে এশিয়ার সেরার কাতারে ফেলার মতো কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। যেমন, গত বছর মার্চে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচির একটি প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহরের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রাজশাহী শহরের নাম ছিল বলে খবরে জানা যায়। এই তালিকায় শীর্ষে ছিল ঢাকা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসার, আবাসিক এলাকায় ঘরের বাইরে শব্দের মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল ও বাণিজ্যিক এলাকা ও ভারি ট্রাফিক অঞ্চলে শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবেলের মধ্যে নির্দিষ্ট রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনটির তথ্য অনুসারে রাজশাহীতে শব্দ দূষণের মাত্রা ১০৩ ডেসিবেল বলে জানা যায়। এই প্রতিবেদন অনুসারে দিল্লি (৮৩), কলম্বো (৮৪), করাচি (৮৯) ও কলকাতার (৮৯) চেয়ে রাজশাহীর শব্দদূষণের মাত্রা বেশি। 

এর আগে, ২০১২ সালে জার্মান সংস্থা সিমেন্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের ১২০টির বেশি শহর নিয়ে দ্য গ্রিন সিটি ইনডেক্স প্রকাশ করে, যেখানে এশিয়ার ২২টি শহর নিয়ে পৃথকভাবে এশিয়ান গ্রিন সিটি ইনডেক্স নামের একটি তালিকা ছিল। কার্বন নিঃসরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানবাহন, ভূমি ব্যবহার, পানি, বায়ু দূষণসহ ৩০টি নির্দেশকের ভিত্তিতে তালিকাটি তৈরি করা হয়। ছয়টি ক্যাটাগরিতে গড় হিসেবে এশিয়ায় তালিকায় শীর্ষে ছিল সিঙ্গাপুর। এই তালিকাতেও বাংলাদেশের কোনো শহর ছিল না।

আরো কিছু লেখা