মিনহাজ আমান
রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য কি উগ্রপন্থীরা ভেঙেছে?
মিনহাজ আমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “উগ্রপন্থীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য নষ্ট করেছে” বলে একটি দাবি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারে ছড়িয়েছে। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, উগ্রপন্থীরা রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য নষ্ট করেছে– এই দাবিটি সঠিক নয়।
Voice Of Bangladeshi Hindus নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের দুটি ছবি (প্রথম ছবিতে তার একটি ভাস্কর্য দেখা যাচ্ছে এবং পরের ছবিতে আছে ভাস্কর্যটির ধ্বংসাবশেষ) পোস্ট করে ক্যাপশনে ইংরেজিতে লেখা হয়: “Extremists have defaced the sculpture of Rabindranath Tagore. Place: TSC, Dhaka University. #HinduphobiaInBangladesh.” যেটির বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায়, “উগ্রপন্থীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য নষ্ট করেছে। স্থান: টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”
পোষ্টটিতে “হিন্দু ফোবিয়া ইন বাংলাদেশ” হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। একই হ্যাশট্যাগে দাবিটি একাধিক টুইটার (১, ২) ও ফেসবুক (১, ২) প্রোফাইলেও পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া সনাতন প্রভাত নামের একটি ওয়েবসাইট এবং রেডিটসহ একাধিক অনলাইন প্লাটফর্মে একই দাবি ছড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক “সেন্সরশিপ ও নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে” বইমেলার প্রবেশমুখে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন একদল শিক্ষার্থী। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা এ ভাস্কর্য নির্মাণ করে।
কারা ভেঙেছে?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ বা ভাস্কর্যটির নির্মাতাদের কেউই দাবি করেনি যে এটি উগ্রপন্থীরা ভেঙ্গেছে। বরং রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটি নির্মাণের সঙ্গে জড়িত এক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন যে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই ধ্বংস করেছে।
ভাস্কর শিমুল কুম্ভকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, “প্রক্টর স্যারও শুরুতে সকালবেলায় আমাদের সাথে একটু মিথ্যা কথা বলেছেন। উনি আমাদের বলেছিলেন উনি একদমই জানেন না, জানার চেষ্টা করছেন। এরকম যখন বলেছেন তখন আমরা ধারণা করি ভাস্কর্যটি কোনো কারণে হয়তো বাইরের কেউ সরাতেও পারে। কোনো রকমের কোন তথ্য ছিল না। তখন এই কারণে কিন্তু ছাত্ররা গিয়ে ‘গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ’ ব্যানার টাঙিয়ে দেয়।”
তিনি গণমাধ্যমটিকে আরো বলেন, “এর কিছুক্ষণ পর আমরা জানতে পারি যে ভাস্কর্যটি প্রক্টরই সরিয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পর খবর পাই যে ভাস্কর্যের ভাঙাচুরা অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পড়ে রয়েছে। তারপরে তো আমরা নিশ্চিত হই আমাদের প্রশাসনই এটা ধ্বংস করছে।”
সরানোর কথা স্বীকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছে যে, টিএসসির ভাস্কর্যটি তারাই সরিয়েছে, যদিও ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়ে তারা কিছু বলেনি।
দ্য ডেইলি স্টার বাংলা সংস্করণে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘রবীন্দ্রনাথের মুখবাঁধা ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলল ঢাবি কর্তৃপক্ষ’। এতে বলা হয়: “সেন্সরশিপ ও নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বইমেলার প্রবেশমুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিবাদী ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজু ভাস্কর্যের পাশে বইমেলার প্রবেশপথে ভাষ্কর্যটি উন্মোচনের ২ দিন পর আজ বৃহস্পতিবার এটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
প্রতিবেদনটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড একেএম গোলাম রব্বানীর বক্তব্য রয়েছে, যেখানে তিনি ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
তিনি পত্রিকাটিকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুন্দর ভাস্কর্যের পাশে আরেক ভাস্কর্য বানানো অপসংস্কৃতি। গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ছাড়া এটি তৈরি করাকে কোনোভাবে আমরা সমীচীন মনে করি না এবং একজন নোবেল বিজয়ী কবির বিকৃত ভাস্কর্যে বানিয়ে তাকে অবমাননা করা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য না।”
ভাস্কর্যটি ঢাবি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরানোর তথ্য অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও (নিউ এইজ, দেশ রূপান্তর, ঢাকা পোস্ট) প্রকাশিত হয়েছে।
পরবর্তীতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার আরেকটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিডিনিউজ২৪-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলছেন, “ভাস্কর্যটি আমরাই সরিয়ে দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজটি করেছে। এ বিষয়ে আমাদের ব্যাখ্যাও আমরা জানিয়েছি।”
বিডিনিউজ ২৪ এর প্রতিবেদনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষের আবক্ষ অংশটি পড়ে থাকার ছবিটিও পাওয়া গেছে।
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা মারফত জানা যায়, “দেশে মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর সেন্সরশিপ এবং সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। সাড়ে ১৯ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষার্থী।” কর্তৃপক্ষ সেটি সরিয়ে নিলেও পরবর্তীতে আবার ভাস্কর্যটির ভাঙাচোরা অংশগুলো এনে আগের জায়গায় স্থাপন করা হয় বলে জানা গেছে দৈনিক আজকের পত্রিকা-র খবরে।
এছাড়া, এই বেঠিক দাবি পোষ্ট করা ভয়েস অফ বাংলাদেশি হিন্দু নামের এই টুইটার একাউন্টের বিরুদ্ধে পূর্বেও ভুয়া খবর ছড়ানোর প্রমান পাওয়া গেছে যা ইতিমধ্যে যাচাই হয়েছে।