তামারা ইয়াসমীন তমা
‘লাল মজলুম’ নাট্য পরিবেশনার দৃশ্যকে শিবির-হিযবুতের হামলা হিসেবে প্রচার
তামারা ইয়াসমীন তমা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনুষ্ঠিত একটি প্রতীকী নাট্য পরিবেশনার ভিডিও শেয়ার করে সম্প্রতি সংস্কৃতি চর্চাকারীদের উপর শিবির ও হিযবুত তাহরীরের হামলার দাবি করা হয়। তবে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি যাচাই করে জানা যায় এটি ‘লাল মজলুম’ নামের একটি গণপরিবেশনার দৃশ্য। ভিডিওতে আক্রমণকারী ব্যক্তিরা ছিলেন ওই পরিবেশনায় অংশগ্রহণকারী নাট্যকর্মী।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একাধিক পেজ থেকে সম্প্রতি ‘শিবির হিজবুতিদের হেলমেট বাহিনীর আক্রমণ’ দাবি করে একটি ভিডিও (১, ২, ৩, ৪) ছড়াতে দেখা যায়। ভিডিওটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সাদা পোশাকের সাধকরূপী একদল শিল্পীকে ঢোল, খঞ্জনি বাজিয়ে গান গাইতে দেখা যায়। গান শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ মাথায় হেলমেট পরা কয়েকজন ব্যক্তিকে লাঠিসোটাঁ হাতে শিল্পীদের উপর হামলা চালাতে দেখা যায়। এরই মধ্যে আরও কয়েকজন এসে লাল কাপড় দিয়ে রাজু ভাস্কর্য ঢেকে দেয়। ভিডিওটি দেখে অনেকেই একে মুক্ত সংস্কৃতির উপর হামলার ঘটনা ধরে নেন। একজন মন্তব্য করেন, “মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চা করবা এখন কর”। আরেকজন একে জামায়াত-শিবিরের হামলা ধরে নিয়ে মন্তব্য করেন, “জামায়াত ও শিবিরের অপরাধের সাথে বিএনপি অবশ্যই জড়িত আছে তারা সঙ্গ দিয়েছেন”।
ভিডিওর শেষে ২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইটের উল্লেখ পাওয়া যায়। সাইটটি যাচাই করে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে ১৬ নভেম্বর ‘লাল মজলুমদের গানের আসরে যা ঘটল’ শিরোনামে মূল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এটি যে পুরোটিই প্রতীকী হামলার দৃশ্য তার কোনো উল্লেখ এতে ছিল না। ফলে ভিডিওটির কমেন্ট সেকশনেও অনেককে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করতে দেখা যায়। একজন ব্যবহারকারী লিখেন, “এতদিন পরে হেলমেট বাহিনীর আসল পরিচয় মিলেছে আমরা আগেও বলেছিলাম এ হেলমেট বাহিনী হচ্ছে জামাত-শিবিরের লোক।”
‘লাল মজলুম’ কীওয়ার্ড ধরে আরও অনুসন্ধান করতেই বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। ১৬ নভেম্বর বিডি নিউজ ২৪ এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১৬ নভেম্বর বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লাল মজলুম’ নামের গণপরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে খণ্ড খণ্ড পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ ও চারুকলা হয়ে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে পরিবেশনার মাধ্যমে তা শেষ হয়। ফকির-সন্ন্যাস বিদ্রোহ থেকে শুরু করে জুলাই-আগস্টে সরকার পতনের গণ আন্দোলনের বিভিন্ন গল্প উঠে আসে এই পরিবেশনায়। এর নির্দেশনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহমান মৈশান।
১৭ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে নাট্যপরিবেশনার পুরো দৃশ্যটির উল্লেখ মিলে। প্রতিবেদনে হামলার দৃশ্যটি ব্যাখ্যা করে বলা হয়, “আচমকা কালো প্যান্ট, কালো টি-শার্ট, মাথায় হেলমেট, লাঠিসোঁটা হাতে একদল হামলাকারী ঝাঁপিয়ে পড়ল গানে মগ্ন সাধকদের ওপর। সাধারণ দর্শকেরা প্রথমে বেশ হকচকিত হয়ে গিয়েছিলেন এই আচমকা আক্রমণে। মাথায় হেলমেট চাপানো একটি বাহিনীর এমন মারদাঙ্গার স্মৃতি জনমানসে এখনো বেশ তাজা। সেই ‘হেলমেট বাহিনী’র কার্যকলাপ যে নাটক হিসেবে (উন্মুক্ত রাজপথ গণপরিবেশনা) অভিনীত হচ্ছে, দর্শকেরা অচিরেই তা বুঝলেন।”
গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতি স্মরণে ‘লাল মজলুম’ শিরোনামে চ্যানেল ২৪ এর প্রতিবেদনেও নাট্যপরিবেশনার দৃশ্যগুলো পাওয়া যায়।
হামলার ঘটনাটি যে প্রতীকী ছিল, তা নিশ্চিত হতে ‘লাল-মজলুম’ পরিবেশনার নির্দেশক ড. শাহমান মৈশানের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত করে বলছি যে আক্রমণের দৃশ্যটি একটি পথনাট্য পরিবেশনার অংশ। এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নেই।”
সাজানো বা স্ক্রিপ্টেড ভিডিও থেকে এর আগেও বিভিন্ন সময় ভুয়া তথ্য ও অপপ্রচার দেখা যায়। বাংলাদেশ ও ভারতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার (এক্স) ও টিকটকে ছড়িয়ে পড়া এমন অন্তত ৭টি সাজানো ভিডিও থেকে কীভাবে ভুয়া দাবি ছড়াতে থাকে তা নিয়ে গত মে মাসে ডিসমিসল্যাব ‘সাজানো ভিডিও যখন বিভ্রান্তির কারণ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।