তৌহিদুল ইসলাম রাসো
রাকিব নামের শিক্ষার্থী মারা যাবার খবরটি ভুয়া
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে রাকিব নামের এক শিক্ষার্থী মারা গেছেন দাবিতে একটি পোস্ট সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। দৈনিক আমার দেশ ও যমুনা টেলিভিশনের গ্রাফিক কার্ড শেয়ার করে একাধিক ব্যবহারকারীকে এমন দাবি করতে দেখা গেছে। কেউ আবার লিখিত পোস্টে এমন দাবি করে বিস্তারিত জানাতে গিয়ে কমেন্টে এসব গ্রাফিক কার্ড যুক্ত করেছেন। তবে যাচাইয়ে দেখা গেছে গণমাধ্যমের এই ফটোকার্ডগুলো ভুয়া। এছাড়া রাকিব আহত হলেও মারা যাননি বলে নিশ্চিত করেছেন তার এক সহপাঠী। ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাকিবের মারা যাবার ভুয়া দাবিতে ছড়ানো পোস্টগুলোর অধিকাংশই ছড়ানো হয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থক পেজ, প্রোফাইল থেকে।
ফেসবুকের কিছু পোস্টে (১, ২, ৩) বলা হয়, ‘ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাকিব নিহত।’ আর দাবিটির সোর্স হিসেবে কমেন্টে দেখতে বলা হয়। পোস্টের মন্তব্যে দেখা যায়, সেখানে দৈনিক আমার দেশের লোগোযুক্ত একটি ফটোকার্ড শেয়ার করা হয়েছে, যার শিরোনামে লেখা “৭ কলেজ ও ঢাবি শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ : ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাকিব নিহত।” ফটোকার্ডটিতে রাকিবের একটি রক্তাক্ত অবস্থার ছবিও যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া উক্ত ফটোকার্ড ভিডিও আকারে (১, ২) বা ছবি হিসেবে পোস্টে (১, ২, ৩) শেয়ার করেছেন অনেকে।
একই ছবি ব্যবহার করে যমুনা টিভির একটি ফটোকার্ডও শেয়ার করা হয়েছে। ফেসবুকের একটি পোস্টে যমুনা টিভির সেই ভুয়া ফটোকার্ডটির সঙ্গে আরও একাধিক ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে রাকিব মারা গেছেন। ফটোকার্ডের শিরোনামে লেখা, “নীলক্ষেত সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী রাকিব মারা গেছেন।”
ফেসবুকে শেয়ার করা ফটোকার্ডগুলো আসল কি না তা জানতে দৈনিক আমার দেশ ও যমুনা টিভির সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। দৈনিক আমার দেশের সহযোগী সম্পাদক আলফাজ আনাম বলেন, “এই ফটোকার্ডটি ভুয়া। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে এমন ফটোকার্ড বানানো হয়নি।” এছাড়া ফটোকার্ডের শিরোনামে ব্যবহার করা ফন্ট ও বাক্যের শেষে ‘দাড়ি’ চিহ্ন ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি জানান দৈনিক আমার দেশ এই ফন্টে গ্রাফিক কার্ড বানায় না এবং শিরোনামের শেষে এমন দাড়িও ব্যবহার করেনা। যমুনা টিভির স্পেশাল করেসপনডেন্ট রাসেল আহমেদও জানান তার প্রতিষ্ঠানের নামে প্রচার করা ফটোকার্ডটি তাদের বানানো নয়। ফটোকার্ডটি সম্পর্কে তাদের জানানো হলে পরবর্তীতে যমুনা টিভি তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এই ফটোকার্ডের তথ্যটি গুজব জানিয়ে পোস্ট করে।
আহত শিক্ষার্থী রাকিবের সর্বশেষ পরিস্থিতি আসলে কি তা জানতে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজের তারই এক সহপাঠী জোবায়ের হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। জোবায়ের জানায় “রাকিবের মারা যাবার তথ্যটি সঠিক নয়। ঢাবির সঙ্গে সাত কলেজের সংঘর্ষে রাকিব আহত হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে একটি অপারেশন শেষে বর্তমানে সে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে আছে।”
এই বিষয়ে জানতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দপ্তর সেল সম্পাদক জাহিদ আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান– রাকিব আহত হয়েছে। বর্তমানে সে হাসপাতালে ভর্তি আছে। নিহত হওয়ার দাবিটি সত্য নয়।
দাবিটি ছড়িয়েছে কারা?
রাকিবের নিহত হবার ভুয়া দাবিতে করা পোস্টগুলো কারা ছড়িয়েছে এবং তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না তা জানতে ফেসবুকে কিওয়ার্ড সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। এক্ষেত্রে ‘রাকিব নিহত’ কিওয়ার্ড সার্চ করে প্রথম ১০০টি পোস্ট বিশ্লেষণ করা হয়। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেখার জন্য প্রতিটি প্রোফাইল বা পেজের প্রোফাইল ও কাভার ফটো এবং বিবরণীতে কী আছে সেটি বিচার করা হয়। ব্যবহারকারী তার প্রোফাইল বা পেজে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক বলে উল্লেখ করেছেন কিংবা প্রোফাইল বা কাভার ছবিতে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের ছবি বা মতাদর্শ দিয়েছেন– এমন কিছু থাকলে তাকে সে দলের সমর্থক বলে বিবেচনা করা হয়েছে। আর এসব না থাকলে প্রোফাইল বা পেজ থেকে কোন দলের সমর্থনে নিয়মিত পোস্ট করা হয়েছে– তা খুঁজে দেখা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে এসব ১০০টি পোস্টের মধ্যে ৮৮টিই শেয়ার করা হয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত পেজ বা প্রোফাইল থেকে। এদের মধ্যে ৬৯টি পেজ বা প্রোফাইলের সঙ্গে সরাসরি আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এই পেজ-প্রোফাইলগুলোর কাভার বা প্রোফাইল ফটোতে শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছিল বা তাদের পরিচিতিতে উল্লেখ করা ছিল যে তারা আওয়ামী লীগ বা এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ১৯টি আইডি বা পেজে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরকম সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে দলটির সমর্থনে একাধিক পোস্ট করা হয়েছে। মাত্র ১টি পোস্ট করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সমর্থক প্রোফাইল থেকে। আর বাকি ১১টি পেজ-প্রোফাইলের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, পাঁচ দফা দাবিতে গত ২৬ জানুয়ারী সন্ধ্যা থেকে আন্দোলন করতে থাকেন সাত কলেজের কয়েকশ শিক্ষার্থী। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে আসেন। এরপর রাত ১১টা থেকে দফায় দফায় ঢাবি ও এই বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় অন্তত পাঁচজন আহত হন।