আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার ও ক্ষোভের পুরোনো ভিডিও যেভাবে ইউনূসবিরোধী প্রচারণায় রূপ নিল

আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার ও ক্ষোভের পুরোনো ভিডিও যেভাবে ইউনূসবিরোধী প্রচারণায় রূপ নিল

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি দুটো ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ কয়েকজনকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর ক্যাপশনে দাবি করা হচ্ছে, এরা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী এবং তাদের মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। আরেকটি ভিডিওতে একজন নারী শিক্ষার্থী সরকারের গণগ্রেপ্তারের সমালোচনা করছেন, যার ক্যাপশনে বলা হচ্ছে, “গণহত্যা শেষ করে এবার গণগ্রেপ্তার শুরু করেছে ইউনূসের সরকার।” কিন্তু যাচাইয়ে দেখা যায়, দাবিগুলো মিথ্যা এবং ভিডিওগুলো পুরোনো।

সামাজিক মাধ্যমে সার্চ করে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায়, দুটি ঘটনাই পাঁচ আগস্ট, অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের; যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তারা মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আটক হয়েছিলেন এবং যেই নারী বক্তব্য দিচ্ছেন তিনিও আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তারের সমালোচনা করছিলেন। আর মিথ্যা দাবির এই ভিডিওগুলো এখন ছড়ানো হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ফেসবুক পেজ ও প্রোফাইল থেকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা হিসেবে।

ভিডিও ১

গতকাল মঙ্গলবার, বিভিন্ন পেজ থেকে প্রথম ভিডিওটি পোস্ট (, , ) করা হয়,  কখনো ক্যাপশন বা বিবরণসহ, কখনো ক্যাপশন ছাড়া। এদের মধ্যে একটি ছিল ‘দেখা হবে রাজপথে’ নামের একটি ফেসবুক পেজের। বিবরণে লেখা, “মিথ্যা মামলায় আসামি ছাত্রলীগ কর্মী…”। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ কয়েকজন ব্যক্তিকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর আবহ সঙ্গীতে “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” শ্লোগানও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্তত দুইটি ভিডিওর বিবরণ ও মন্তব্যে “#StepDownYounus” হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। একটি মন্তব্যে বলা হয়েছে, “ইউনুসের এই মুহূর্তে পদত্যাগ করা উচিত, দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার ব্যার্থতার জন্য!”

একই ভিডিও ‘চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামীলীগ’ নামের একটি পেজ থেকেও শেয়ার করা হয়।  বিবরণে কিছু লেখা নেই, তবে এর নিচে আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক মন্তব্য করেছেন। যেমন, একজনের মন্তব্য ছিল: “জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু তোমাদের জন্য দোয়া রইল ভাই অবশ্যই বিজয় আসবে।” ভিডিওটি এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশিবার শেয়ার হয়েছে।

সূত্র যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়,  হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি গত পহেলা আগস্টের। ৩১ জুলাই, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। সেসময় খুলনা থেকে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। এদের মধ্যে অনেককে ছেড়ে দেওয়া হলেও ১ আগস্ট, ১১ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। ভিডিওটি ছিল তাদেরকে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানোর সময়কার। এই ১১ জনের মধ্যে একজন ছিলেন নিয়াজ মুর্শিদ দোলন।

মিথ্যা দাবিতে ছড়ানো ভিডিওটিতে একেবারে সামনে, ডানে যে ব্যক্তিকে যেখা যাচ্ছে, তিনিই এই দোলন। ৩১ জুলাইয়ের একটি ফেসবুক পোস্টে, একজন ব্যবহারকারী তার গ্রেফতার হওয়ার সময়ের একটি ছবি পোস্ট করেন। ছবিটির ক্যাপশনে ছিল “দোলন ভাই ৩১ জুলাই, ২০২৪।” ছবিটিতে তাকে যে পোশাকে দেখা যায় সেই একই পোশাক দেখা যায় আওয়ামী সমর্থক বিভিন্ন পেজ থেকে পোস্ট হওয়া সাম্প্রতিক ভিডিও রিলে।

৩১ জুলাই, আরেকজন ব্যবহারকারী লেখেন, “দোলন ভাইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাকে সোনাডাঙ্গা থানায় আটকে রাখা হইছে।” দুই আগস্টের একটি ফেসবুক পোস্টে, একজন ব্যবহারকারী দোলনকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানান। এই পোস্টের ছবিতে আরও দুইজনকে দেখা যাচ্ছে যাদেরকে ‘চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামীলীগ’ এবং ‘দেখা হবে রাজপথে’ নামের পেজের রিল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিল, একই পোশাক এবং স্থানে।

ভিডিও দুই

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ধারণ করা আরেকটি ভিডিও পোস্ট করা হয় “সাপোর্টার্স অফ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” গ্রুপে, যার ক্যাপশনে লেখা, “ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ, সবাই বুঝতেছে আগেই ভালো ছিলাম।” পোস্টে #CountdownStarted এবং #StepdownYounus হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়। ভিডিওটিতে এক নারীকে বলতে শোনা যায়, “গণহত্যার কথা এবার আমি থামালাম, এখন যেটা শুরু হয়েছে সেটা হচ্ছে গণগ্রেফতার। প্রমাণ থাকুক, না থাকুক গ্রফতার করে নিয়ে যাও।” পোস্টটিতে একজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “আগেই ভালো ছিলাম।” আরেকজন ব্যবহকারী লিখেছেন, “ডঃ ইউনুস বলেছেন আপনারা আমার বেশী বেশী সমালোচনা করুন। এখন দেখছি হিতের বিপরিত, সমালোচনা করলে মামলা ও চাকুরীচ্যুত হতে হয়।” অর্থাৎ, এটিকে অনেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে দেয়া বক্তব্য মনে করছেন।

একই ভিডিও “সত্যের পথে বাংলাদেশ” নামের আরেকটি পেজও পোস্ট করেছে। সেটির বিবরণে লেখা হয়েছে, “গণহত্যা শেষ করে এখন গণগ্রেপ্তার শুরু করেছে ইউনুসের সরকার”। ভিডিওটি আওয়ামী লীগ সমর্থক বেশ কিছু পেজ ও প্রোফাইল থেকেও (, , , )  প্রচারিত হতে দেখা গেছে।

সূত্র খুঁজতে গিয়ে, ভিডিওটি পাওয়া যায়, বেসরকারি টেলিভিশন মাই টিভির ইউটিউব চ্যানেলে, যা আপলোড করা হয় গত ২ আগস্ট। সেটিরও শিরোনামও ছিল: “গ’ণ’হ ‘ত্যা শেষ, এখন শুরু গণ’গ্রে ‘প্তার”, কিন্তু প্রেক্ষাপট পুরোপুরি আলাদা। ভিডিওতে যে নারী বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তিনি মূলত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের দমন নীতির সমালোচনা করেছিলেন। ভিডিওর ২৩ সেকেন্ডে তাকে বলতে শোনা যায়, “এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার নিয়ে। এটা কোনো সরকারের বিপক্ষে ছিল না, কোনো দলের বিপক্ষে ছিল না।” এই ভিডিওটির একটা সংক্ষিপ্ত ক্লিপ শর্টস আকারে মাই টিভির ইউটিউব চ্যানেল থেকে পোস্ট করা হয় ৩ আগস্ট। এই শর্টসটিই এখন নতুন করে সামনে এসেছে, তবে আওয়ামী লীগ নয় বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা হিসেবে।

আরো কিছু লেখা