ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
রাফি নয়, পতাকা জড়ানো দেহটি জুলাই আন্দোলনে নিহত জাহিদুলের

রাফি নয়, পতাকা জড়ানো দেহটি জুলাই আন্দোলনে নিহত জাহিদুলের

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক তরুণের পতাকা জড়ানো দেহের ছবি ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বেশকিছু পোস্টের দাবি, তিনি ‘শহীদ রাফি’– যিনি গত বছরের জুলাই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন। আবার কিছু পোস্টে দাবি করা হচ্ছে ছবিটি রাফি নামের একজন জুলাই আন্দোলনকারীর, যিনি এখনও জীবিত। দাবিগুলো ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি ও আলোচনা। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, গত বছর থেকেই বিভিন্ন সময় রাফি নামের একজন আন্দোলনকারীর নামে ছবিটি ছড়াতে থাকে, যিনি পাবনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন। তবে ডিসমিসল্যাব নিশ্চিত করেছে যে, ছবিটি রাফির নয়। ছবিটি পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. জাহিদুল ইসলামের। জাহিদুল ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ছবিটি দেখে জাহিদুলের পরিবার ডিসমিসল্যাবকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

গত বছর থেকেই রাফির নামে ছড়ায় জাহিদের ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে কাজ করে এমন একটি ফেসবুক পেজ হিস্ট্রি অব জুলাই থেকে অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণে গত ৪ জুলাই পতাকায় মোড়ানো এক ব্যক্তির ছবি শেয়ার করা হয়। ক্যাপশনে লেখা হয়,

“আমার বাবা মারা গেছেন। আপনারা প্লিজ আমার বোনটাকে দেখে রাখবেন—এটাই ছিল রাফির শেষ কথা, মৃত্যুর আগমুহূর্তে। এই জুলাই মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি রাফির মতো সেসব মানুষকে, যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য।”

ছবিতে থাকা নিহত ব্যক্তি রাফি বলে বিভ্রান্তিকর দাবি করা পোস্টের স্ক্রিনশট

এছাড়াও একাধিক ফেসবুক পোস্ট (, , ) পাওয়া যায়, যেখানে ছবিটি রাফির নামে ছড়ায়। তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, এই দাবিটি নতুন নয়। ২০২৪ সাল থেকেই একই ছবি ও বক্তব্য অনলাইনে ছড়াচ্ছে।  ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট একাধিক ফেসবুক পোস্ট (, , , ) ও এক্সে ছবিটি শেয়ার করে তাকে ‘পাবনায় নিহত রাফি’ বলে দাবি করা হয়। ছবিটি সেসময় রাফিউল ইসলাম রাফির নামে ছড়ায়, যিনি তখন পাবনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন।

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান বুম সেসময় সরাসরি রাফির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত করে যে তিনি বেঁচে আছেন। রাফি নিজেই জানান, “আমার বাবা নেই, ছোট একটা বোন আছে। কেউ দেখে রাইখেন”—এই কথাগুলো তিনি বলেননি। পাবনার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম পাবনাবার্তানিইউজ২৪.কম-এ দেওয়া তার একটি সাক্ষাৎকারেও মৃত্যুর গুজবটি খণ্ডন করা হয়।

তবে ২০২৪ সালে এই গুজব ছড়ানোর সময় বুম রিউমর স্ক্যানার দাবিটি যাচাই করলেও, ছবির পরিচয় যাচাই করা হয়নি এবং ছবিটি পরবর্তীতেও বিভিন্ন সময় রাফির নামে ছড়াতে থাকে।

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান বুম বাংলাদেশ-এর ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন

নিহত জাহিদের ছবি ব্যবহার করে তাকে জীবিত দাবিতে প্রচার

চলতি বছর পুনরায় ছবিটি রাফির দাবি করে তিনি জীবিত আছেন বলে ছড়ায়। গত ৫ জুলাই রেবেলিয়াস রোর নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ছবিটিসহ একাধিক স্ক্রিনশটের কোলাজসহ একটি পোস্টে লেখা হয়:

“আমার বাবা নেই। ছোট্ট একটা বোন আছে। কেউ দেখে রাইখেন। এইসব ইমোশান দেখে যেকারও অর্গাজম হয়ে যাওয়ার কথা। পরে সে জুলাই শহীদ কবর থেকে ফিরে এসে সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। লল! পুরো জুলাই জুড়ে এসব করে গেসে এস্তোনিয়ার আমিনুল। বেচারার আশা ছিলো বেগম রোকেয়ার ভিসি হবে। (জুলাই জুড়ে জুলাই স্ক্যাম এক্সপোজ করা হবে। যাদের কাছে যত গুজব আছে সেগুলো ইনবক্সে/কমেন্টে দিবেন। ধন্যবাদ)”

একাধিক পোস্টে (, , ,) দাবিটি ছড়াতে দেখা যায়।

নিহত জাহিদের ছবি নিয়ে জীবিত দাবি করে বিভ্রান্তিকর প্রচার

ছবির সত্যতা যাচাই

ছবিটি রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধানে গত বছর ৭ আগস্টের একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টটিতে বলা হয়, 

“পাবনা জেলায় জাহিদই প্রথম শহীদ হয়েছে। জাহিদ এর বাসা চরবলরামপুর, ভাঁড়ারা ইউনিয়ন, পাবনা সদর, পাবনা। জাহিদরা তিনভাই এক বোন! জাহিদ এলাকার ভিতর শান্ত সৃষ্ট ভদ্র একটা ছেলে। আমি কোনো দিন দেখিনি ওহ মাথা তুলে কারো সাথে জর গলায় কথা বলেছে। এতটা ভালো যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ভালো মানুষ নাকি পৃথিবীতে বেশি থাকে না। আল্লাহ ভাতিজাকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন এবং  জান্নাতুল ফেরদৌসের দান করুন।”

এই পোস্টটিতে ওই ছবিটি ছাড়াও বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে বডিটির আরও দুটো ছবি পাওয়া যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পাবনায় নিহত জাহিদুল ইসলামের বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করে তার নামে একাধিক সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়।  দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পাবনায় গত ৪ আগস্ট গুলিতে নিহত হন দুই শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে একজন উনিশ বছরের তরুণ জাহিদুল ইসলাম।” 

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, “পাবনা সদর উপজেলার চর বলরামপুর গ্রামের দুলাল উদ্দিন ও আফিয়া খাতুন দম্পতির সন্তান জাহিদুল ইসলাম। পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিকস বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন তিনি। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন জাহিদ। তাঁর বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মা গৃহিণী।”

দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকাতেও জাহিদুল ইসলামকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।  জুলাই শহীদ ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইটেও মো: জাহিদুল ইসলামের পরিচয় ও জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

নিহত জাহিদকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন - ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেক

ছবিটি জাহিদের কিনা সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে তার পরিবারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব টিম। ছবিটি দেখানোর পর, জাহিদুলের বড় ভাই মো. তৌহিদুল ইসলাম ডিসমিসল্যাবকে নিশ্চিত করেন যে পতাকা দিয়ে ঢাকা ব্যক্তি হলেন মোঃ জাহিদুল ইসলাম। ৪ই আগস্ট আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে জাহিদ গুলিবিদ্ধ হন এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এছাড়া জাহিদুল ইসলামের বাবাও জীবিত রয়েছেন। তার সঙ্গেও ডিসমিসল্যাব টিমের কথা হয়। জাহিদের বড় ভাই জানান, মৃত্যুর আগে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া কথা গুলোও জাহিদের নয় বলেই তার ধারণা।

অর্থাৎ, জাহিদুল ইসলামের পরিবার থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পতাকা জড়ানো দেহটি গত বছর জুলাই আন্দোলনে নিহত পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. জাহিদুল ইসলামের।

আরো কিছু লেখা