তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
লাইভে পুরোনো ভিডিও, ছবিও আগের, ফেসবুকে বিভ্রান্তি
This article is more than 1 month old

লাইভে পুরোনো ভিডিও, ছবিও আগের, ফেসবুকে বিভ্রান্তি

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলন নিয়ে চলমান অস্থিরতার মধ্যে নয় দফা দাবি আদায়ে ২৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কর্মসূচির দিন বেশকিছু ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেগুলোতে দাবি করা হয় মিরপুর-২, মিরপুর-১০ সহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলনে নেমেছে। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, বেশকিছু ভিডিও ও ছবি কয়েকদিন আগের পুরোনো। এরমধ্যে আছে মিরপুর-১০ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনের পুরোনো দৃশ্য, যা ফেসবুকে ‘লাইভ’ সম্প্রচার করা হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষসহ আন্দোলনরত অনেকে বিভ্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। অনেক শিক্ষার্থী বলেছেন, ভিডিও ও ছবি দেখে আন্দোলনে অংশ নিতে এসে তারা পুলিশি হেনস্তার শিকার হয়েছেন। পুরোনো ভিডিও লাইভ আকারে সম্প্রচার ফেসবুকের নীতিমালারও লঙ্ঘন।

চলমান কোটা আন্দোলনে ছয় সমন্বয়কের কর্মসূচি বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ জুলাই দিবাগত রাতে ফেসবুকের বেশকিছু গ্রুপ ও আইডি থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা হয়। কর্মসূচিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ করে ২৯ জুলাই বেলা ১১টায় সেখানে গণজমায়েত হতে আহ্বান জানানো হয়। এরপর বেলা গড়াতে বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজে মিরপুর ১০ ও ২ নাম্বারে গণজমায়েতের একটি ছবি (, , ) ও ভিডিও (, , , ) প্রচারিত হতে দেখা যায়। এর মধ্যে ‘শারিয়ের ভাই’ পেজ থেকে প্রচারিত একটি লাইভ ২৩ হাজার বার শেয়ার করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, অসংখ্য শিক্ষার্থী মিরপুর ১০ গোলচত্বরে মেট্রোস্টেশন লাগোয়া ফুটওভার ব্রিজের নিচে জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছে। একদল শিক্ষার্থীর হাতে বাংলাদেশের বিশাল একটি পতাকাও দেখা যায়। লাইভের ক্যাপশনে লেখা, “মিরপুর ১০, ২ ঘুরে যা দেখলাম ট্যাট্যা ছাত্ররা মাঠ ছাড়েনই বরং বহুগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে!” যাচাইয়ে দেখা যায়, মুনতাকিম রাজীব নামে একজন গত ১৬ জুলাই ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোড করেছিলেন। থার্ড পার্টি অ্যাপের মাধ্যমে ফেসবুকে এটি লাইভ করা হয়।

মিরপুর ১০ গোলচত্বরে গণজমায়েতের স্থিরচিত্রগুলোও অন্তত ১৩ দিন আগের। ১৬ জুলাই প্রকাশিত ভিডিওর দৃশ্যপটের সঙ্গে ছবিটির সাদৃশ্য রয়েছে। গত ১৮ জুলাই মিরপুর ফুটওভার ব্রিজ ও পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পরদিন মিরপুর-১০ মেট্রোরেল স্টেশনেও হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। যার পর থেকে মেট্রোরেল স্টেশন বন্ধ রয়েছে। তবে ২৯ জুলাইয়ের বলে দাবি করা ছবি ও ভিডিওতে মেট্রোরেল স্টেশনের গেট খোলা দেখা যায়। এ থেকেও স্পষ্ট হয়, ছবি ও ভিডিওটি ২৯ জুলাইয়ের আগে ধারণ করা। 

মিরপুর-১০ এর পুরোনো ভিডিওটি কয়েকটি ফেসবুক পেজ (, ) থেকে ২৯ জুলাইয়ের দাবিতে সরাসরি লাইভ সম্প্রচার হতে দেখা যায়। এছাড়া ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকেও সরাসরি মিরপুর থেকে লাইভ হিসেবে পুরোনো ভিডিও সম্প্রচার করতে দেখা যায়।

মিরপুরের এই ভিডিওটি শারিয়ের ভাই নামের ফেসবুক পেজ থেকে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তিনবার লাইভ প্রচারিত হয়। প্রথম লাইভটি হয় দুপুর একটা ৪১ মিনিটে। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার একই ভিডিও বিকেল চারটা ৪৩চারটা ৫৯ মিনিটে সম্প্রচারিত হয়। পেজটি ঘুরে দেখা যায়, ২৯ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পেজটি থেকে অন্তত ৬টি লাইভে পুরোনো ভিডিও প্রচারিত হয়েছে। আজ ৩০ জুলাইও একই ভিডিও সেখান থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। প্রতিবারই তারা একই ভিডিও বিভিন্ন সময়ে প্রচার করেছে।

পেজটির অন্যান্য লাইভের মধ্যে একটি ভিডিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শিক্ষার্থীদের সমাবেশের। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মাঠ ছাড়েনি বরং বহুগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে।” ভিডিওর শুরুতে দেখা যায়, একজন অচেতন নারী শিক্ষার্থীকে কয়েকজন আন্দোলনকারী ধরাধরি করে রিকশায় তুলে দিচ্ছে। এরপর ভাস্কর্যের পাদদেশে আন্দোলনকারীদের ভাষণ ও স্লোগান দিতে শোনা যায়। যাচাইয়ে দেখা যায় ভিডিওটি অন্তত ১২ দিনের পুরোনো। জাহিদ হাসান ৭৫ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৭ জুলাই ভিডিওটি আপলোড করা হয়।

চলমান দৃশ্য বলে দাবিকৃত এসব ভিডিওর সঙ্গে জলছাপ আকারে ‘গো লাইভ ইন্ডিয়া স্ট্রিমিং অ্যাপ’ স্ক্রল হতে দেখা গেছে। যাচাইয়ে দেখা যায়, গো লাইভ ইন্ডিয়া একটি ভারতীয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এর সাহায্যে পুরোনো বা রেকর্ডেড ভিডিও লাইভ হিসাবে প্রচার করা সম্ভব হয়। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তাদের এ অ্যাপ দিয়ে একাধিক ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে একসঙ্গে লাইভ সম্প্রচার করা সম্ভব।

ফেসবুকের নীতি হচ্ছে, কোনো প্রি-রেকর্ডেড ভিডিও লাইভ সম্প্রচার করতে হলে অবশ্যই ভিডিওতে ডিসক্লেইমার হিসেবে উল্লেখ করতে হবে যে ভিডিওটি আগে ধারণকৃত। কিন্তু এসব পেজ বা আইডিতে লাইভ আকারে প্রচারিত কোনো ভিডিওতেই এ শর্ত মানা হয়নি।

পুরোনো এসব ভিডিও নতুন হিসেবে প্রচারিত হওয়ায় বিব্রতকর অবস্থায় পরে আন্দোলনে অংশ নিতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। ফেসবুকের দুই লাখ ৮৭ হাজার সদস্যের ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপ ঘুরে দেখা যায়, ২৯ জুলাই গ্রুপটিতে ৩৯টি পোস্ট এসেছে যেখানে সদস্যরা মিরপুর ২, মিরপুর ১০ ও ইসিবি চত্বরের সাম্প্রতিক অবস্থা জানতে চেয়েছেন। 

২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে এ ধরনের ভুয়া খবর ছড়ানোকে দায়ী করেছেন আন্দোলনে সমর্থনকারী অনেকে। আহমেদ অয়ন নামের একজন লেখেন, “মিসলিডিং হইলো, কে কোথায় আছে, কোথায় সেফ প্লেস কোথায় ট্র‍্যাপ এটা নিয়ে একটা গোজামিল হয় আর সঠিক তথ্য কেউ দিতে না পারায় ছাত্ররা বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। ভিতরে ভিতরে কেউ গুজব ছড়াইতে পারে বলা যায় না, কিন্তু এই ইনফরমেশন এর জন্যই আজকের ইউনিটিটা ছিলো না।”  নিহিতা বিনতে জামান নামের একজন লেখেন, “এই মুহূর্তে কেউ ইসিবি এবং মিরপুর ১০ যাবেন না কোনো ছাত্রজনতার ঢল নামে নি। ইটস আ ট্র্যাপ। সময়: ১২:৪৬।” 

বিইউপির (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস) একজন শিক্ষার্থী ডিসমিসল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, শিক্ষার্থীদের জমায়েতের খবর শুনে মিরপুর-২ এ এসে তিনি ঝুঁকিতে পড়েছিলেন। এই শিক্ষার্থী বলেন, “বেশ কয়েকবার ঘোরাফেরা করেও আমি শান্তিপূর্ণ কোনো সমাবেশের চিহ্ন দেখি নাই।” তিনি আরও বলেন,  “এক শিক্ষার্থীর কাছে খবর পেয়ে আমরা কয়েকজন কাচ্চি ভাইয়ের পেছনের গলিতে যাই, কারণ সেখানে শিক্ষার্থীরা একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। সেখানে ৩-৪ জনের ছোট ছোট গ্রুপে প্রায় ১৫-২০ বা ২৫জন ছিল। তখন আমাকে একজন ফোন করে বলে যে, কাচ্চি ভাইয়ের সামনে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তখনই ১০-১২টা মোটরসাইকেলে করে পুলিশ এসে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আমিসহ আরও কয়েকজন তখন কাচ্চি ভাইয়ের সামনে এসে দেখি যে সেখানে কিছুই নেই। রাস্তায় স্বাভাবিকভাবেই গাড়ি চলছে। ছাত্রদের সমাবেশের বা এমন কিছুর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে এই আশঙ্কায় আমার সাথে থাকা বাকিদের চলে বাসায় চলে যেতে বলি।”

উল্লেখ্য যে, ২৮ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা শাখা কার্যালয়ের ‘নিরাপত্তা হেফাজত’-এ থাকা অবস্থায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ছয় সমন্বয়ক। তাদের এই বিবৃতি জোর করে আদায় করা হয়েছে দাবি করে পরদিন ২৯ জুলাই দেশব্যাপী ‘মহা আন্দোলন’ কর্মসূচীর ডাক দেয় শিক্ষার্থীরা।

আরো কিছু লেখা