আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
গোপালগঞ্জের সংঘাতে ছড়িয়েছে যত অপতথ্য

গোপালগঞ্জের সংঘাতে ছড়িয়েছে যত অপতথ্য

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত ১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এতে সংঘর্ষে চারজন নিহত, অন্তত নয়জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। এই সংঘর্ষকে ঘিরে বেশ কিছু ভুল তথ্যও ছড়াতে দেখা গেছে। পুরোনো ছবি-ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়েছে সেগুলো গোপালগঞ্জের সংঘর্ষের সময় ধারণ করা দৃশ্য। যদিও যাচাইয়ে দেখা গেছে দাবিগুলো সঠিক নয়। 

পুরোনো বিভিন্ন ঘটনার ছবি ভুল দাবিতে প্রচার

সামাজিক মাধ্যম এক্সে একটি পোস্টে দাবি করা হয়,  “গোপালগঞ্জে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে পুলিশের পোশাক পরে সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে গু/লি চালাচ্ছে এনসিপি ও শিবির। নারী ও শিশু সহ গু/লিবিদ্ধ ১৩ জন। পুলিশের পোশাকের আড়ালে এরা এনসিপি ও শিবির সন্ত্রাসী (দেশদ্রোহী রাজাকার)। এনসিপির নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়েছে।” পোস্টটিতে চারটি ছবিও যুক্ত থাকতে দেখা যায়। একটি ছবিতে বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি তাক করে থাকতে দেখা যায়। এর মধ্যে কয়েকজন পুলিশকে ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের (ডিবি) ভেস্ট পরে ছিল।

ছবিটি বিশ্লেষণে দেখা যায় এটি প্রায় তিন বছর পুরোনো একটি ঘটনার দৃশ্য। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে ঢাকা টাইমসের একটি প্রতিবেদনে এই ছবিটি দেখা যায়। সংবাদের শিরোনাম ছিল “না.গঞ্জে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ: গুলি ছোড়া সেই এসআই ক্লোজড।” প্রতিবেদনে বলা হয়, “নারায়ণগঞ্জে গত ১ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে এক পুলিশ কনস্টেবলের কাছ থেকে চাইনিজ রাইফেল নিয়ে গুলিবর্ষণকারী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মাহফুজ কনককে ক্লোজ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।” এটির সাথে গতকালের গোপালগঞ্জের সংঘর্ষের ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।

পোস্টের আরেকটি ছবিতে কিছু ব্যক্তিকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। এই ছবিটির সূত্র যাচাই করতে গেলে দেখা যায় এটি ২০২৩ সালের একটি ঘটনার দৃশ্য। এই ছবিযুক্ত নিউজ বাংলা২৪ ডটকমের ২০২৩ সালের ২৩ মার্চের একটি প্রতিবেদনে শিরোনাম ছিল, “গোপালগঞ্জে ইউপি নির্বাচনে সংঘর্ষ গুলি, আহত ২৫।” ঘটনার বিবরণে বলা হয়, “সদর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ফল বাতিলের দাবিতে তিন মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালালে সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি চালায়। আহত হয়েছেন আইন-শৃংখলা বাহিনীর ১০ সদস্যসহ ২৫ জন। দুজনকে আটক করা হয়েছে।” অর্থাৎ, এটির সাথেও সম্প্রতি হওয়া গোপালগঞ্জের ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।

পোস্টে আরও দুটি ছবি রয়েছে যার একটিতে দেখা যায় কয়েকজন ব্যক্তিকে একজন শিশুকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন এবং আরেকটিতে একটি গাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখা যায় । এই ছবিগুলোর সূত্র খুঁজতে গেলে ডিসমিসল্যাব খুঁজে পায় দৈনিক দেশ সময় নামের একটি গণমাধ্যমের ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদন। ২০২৪ সালের ১০ আগস্টের এই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর গুলিতে শিশু আহত বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীর গাড়িতে আগুন।” প্রতিবেদনে বলা হয়, “শনিবার ১০ই আগষ্ট বিকাল আনুমানিক ৫টার সময় গোপালগঞ্জের গোপিনাথপুর ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেন গোপীনাথপুর ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভ চলাকালে বিক্ষোভ কারীদের বাধা দেয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল চলমান রাখে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সাথে সাধারণ মানুষের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের সেনাবাহিনীর গুলিতে এক শিশু আহত হন। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীর গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।” অর্থাৎ, এটি গত বছর আগস্টের গোপালগঞ্জের ঘটনা, সাম্প্রতিক নয়।

১৬ জুলাইয়ের ঘটনার সাথে এই ছবিগুলো যুক্ত করে পোস্ট হতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকেও (, , , )।

জুলাই আন্দোলনের সময়ের ছবি পাল্টাপাল্টি দাবিতে প্রচার

তিনটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট হতে দেখা যায় পাল্টাপাল্টি দাবিতে। কেউ কেউ এই ছবিগুলো পোস্ট করে দাবি করে যে এগুলো ১৬ জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দ্বারা গুলি চালানোর দৃশ্য (, , , )। আবার কোন কোন ব্যবহারকারী এগুলোকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর সদস্যদের গুলি চালানোর দৃশ্য বলে পোস্ট করতে দেখা যায় (, , )।

এই ছবিগুলোর সূত্র যাচাইয়ে দেখা যায় উপোরক্ত কোন দাবিই সঠিক নয়। ছবিগুলোর প্রত্যেকটিতেই একাধিক ব্যক্তিকে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা যায়। এর মধ্যে দুটি ছবির সূত্র পাওয়া যায় ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদনে। পোস্টগুলোতে ব্যবহৃত দুটি ছবিতে দু’জন ব্যক্তিকে দেখা যায় যাদের একসঙ্গে ছবি পাওয়া যায় খবরের কাগজের একটি প্রতিবেদনে। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “চট্টগ্রামের সংঘর্ষে নিহত ৩”। প্রতিবেদনে যুক্ত ছবির ক্যাপশনে বলা হয়, “আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছুড়েন দুই যুবক।” ঘটনাটি মূলত ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ের। প্রতিবেদনে অনুসারী সেই দিন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকলে আন্দোলনকারীরা শহরে জড়ো হলে চট্টগ্রামের মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট এলাকায় শিক্ষার্থীদের একাংশের সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘর্ষ হয় এবং শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে ছাত্রলীগ কর্মীরা অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়ে। অর্থাৎ, এই ছবি দুটো প্রায় এক বছর পুরোনো।

পোস্টের আরেকটি ছবিতে হেলমেট পরিহিত একজনকে গুলি তাক করে থাকতে দেখা যায়। এই ছবিটির সূত্র খুঁজতে গেলে ২০২৪ সালের ২৫ অক্টোবরে যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন সামনে আসে ডিসমিসল্যাবের। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করা সেই ফিরোজ গ্রেফতার।” প্রতিবেদনে বলা হয়, “চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে সায়মন ওরফে মাহিন নামের দোকান কর্মচারী হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি যুবলীগ কর্মী মো. ফিরোজ গ্রেফতার হয়েছে। র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের একটি দল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে তাকে ফেনী সদর মডেল থানাধীন রামপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে নগরীর মুরাদপুর ও বহদ্দারহাট এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।” অর্থাৎ, এই ছবিটিও ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ের।

পুরোনো ঘটনার দৃশ্য গোপালগঞ্জের দাবিতে প্রচার

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে পোস্ট হওয়া একটি ভিডিওতে একজন ব্যক্তিকে পুলিশ ভ্যানে তোলার দৃশ্য দেখা যায়। এক্সের একটি পোস্টের ক্যাপশনে বলা হয়, “আওয়ামী লীগ পুলিশ হত্যার বিচার করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে রাজনীতি করছে, আর পুলিশ আজ গোপালগঞ্জে আমাদের নেতাকর্মীদের লাশ ময়লার মতো নিক্ষেপ করছে।” এই ভিডিওটি অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমেও পোস্ট হতে দেখা যায় (, )।

ভিডিওটির সূত্র যাচাই করতে গেলে প্রাণের ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের একটি পেজ পোস্ট পাওয়া যায়। চলতি বছরের ৪ জুনে পোস্ট হওয়া এই ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা ছিল, “ভাদুঘর বাস স্ট্যান্ড গরুর বাজারে এক ছিনতাইকারীকে ধরে গণধোলাই দেওয়া হয়েছে এবং পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।” অর্থাৎ, এটিও পুরোনো ভিডিও যার সাথে গোপালগঞ্জের ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।

১০ মাস পুরোনো ভিডিও ভুল দাবিতে প্রচার

এক্সে একটি শিশু ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয় এটি গোপালগঞ্জের ঘটনার। পোস্টের ক্যাপশনে বলা হয়, “তবে ছবির এই শিশুকে দেখুন, একজন সত্যিকার মুজিব সৈনিক। যদি গোপালগঞ্জ কখনও হুমকির মুখে পড়ে সে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে রাজি।” একই ভিডিও পোস্ট হতে দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক এবং ইউটিউবেও

ভিডিওটির সূত্র যাচাইয়ে দেখা যায় এটিও সাম্প্রতিক কোন ঘটনার দৃশ্য নয়। একই শিশুর অন্তত এক বছর পুরোনো ভিডিও পাওয়া যায়। ২০২৪ সালের আগস্টের ৮ তারিখের একটি পোস্টে লাঠি হাতে শিশুটিকে রাস্তায় হাঁটতে দেখা যাচ্ছে এমন ভিডিও যুক্ত থাকতে দেখা যায়। ২০২৪ এর ২৭ আগস্টে পোস্ট হওয়া একটি রিলে হুবহু একই দৃশ্যটি দেখা যায়। অর্থাৎ, এই ঘটনাটি সাম্প্রতিক নয়।

ভিন্ন ঘটনার ভিডিও এনসিপির নেতাকর্মী দাবিতে প্রচার

“এনসিপি নেতারা সেনাবাহিনীর পায়ে ধরতেছে জীবন বাঁচাতে” এমন দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার হয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হয়, “কর্মীদের ফেলে নেতারা থানায় আশ্রয় নিয়েছে , সেনাসদস্যদের পা ধরে কর্মীদের আকুতি…।” একই দাবিতে একাধিক ব্যবহারকারী এবং পেজকে পোস্ট করতে দেখা যায় (, , , )।

ভিডিওটির যাচাই করতে গেলে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে চলতি বছরের ১৮ মে পোস্ট হওয়া একটি ভিডিও যার ক্যাপশনে লেখা, “সেনাবাহিনীর পায়ে ধরলেন, সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরা”।  পোস্টের ভিডিওটির সাথে উপরের ভিডিওটির হুবহু মিল পাওয়া যায়। চাকরিচ্যুত সেনা সদস্যদের আন্দোলন নিয়ে ১৯ মে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, “চাকরি ফিরে পাওয়াসহ চার দফা দাবিতে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন সময় সশস্ত্র বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতরা। রোববার সকাল থেকে দিনভর জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় বিক্ষোভ করেন তারা। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে বিকেলে প্রেসক্লাবে যান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।” এই ঘটনাটিও সাম্প্রতিক না এবং এটির সাথেও গোপালগঞ্জের ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।

উল্লেখ্য, ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’র কর্মসূচি হিসেবে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি পালন করতে গোপালগঞ্জ পৌছায় দলটির নেতাকর্মীরা। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জেলাটিতে উত্তেজনা তৈরি হয় এবং এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা করা হয়। পরবর্তীতে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরেও হামলা হয়। হামলাকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় এবং অন্তত চার জন নিহত হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়। এরপর গোপালগঞ্জে কারফিউ ঘোষণা করা হয় যা ১৮ জুলাই সকাল ১১টা পর্যন্ত চলবে বলে জানা যাচ্ছে।

আরো কিছু লেখা