তৌহিদুল ইসলাম রাসো
তিনবার যাচাই হওয়া বিকৃত ভিডিও ফেসবুকে চলছে বিজ্ঞাপন দিয়ে
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও ও রিল আকারে ছড়াতে দেখা গেছে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের একটি ক্লিপ, যেখানে খালেদা জিয়াকে আন্দোলন, পুত্র তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী সংক্রান্ত একাধিক মন্তব্য করতে দেখা যায়। ভিডিওটি ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছরই নানাভাবে প্রচারিত হতে দেখা গেছে ফেসবুকে। কিন্তু ভিডিওটি বানানো হয়েছে ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার লন্ডনে দেওয়া একটি বক্তব্যের একাধিক অংশকে কাটছাঁট করে। এবং এখন পর্যন্ত এই ভিডিওটি অন্তত তিনবার যাচাই করেছে ফ্যাক্টচেকিং সংগঠনগুলো। তারপরও সম্প্রতি ভিডিওটি ফেসবুকে প্রচারিত হতে দেখা গেছে বিজ্ঞাপন আকারেও।
উক্ত ভিডিওতে খালেদা জিয়াকে বলতে শোনা যায়- “আপনারা যতই বলেন যে আন্দোলন; আন্দোলন ঢাকায় সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। এখানে আবার পরিবারের মধ্যে গণ্ডগোল আছে। তারেক রহমানকে তো আপনারা ভাল করেই চিনেন। বউ এর সঙ্গেও গণ্ডগোল, বউও চায় ক্ষমতা, সেও চায় ক্ষমতা”। সম্প্রতি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করা ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “দুর্নীতি, ঝামেলা এগুলো নিজের পরিবারেই। তিনি আবার দেশ সামলাবেন।”
“বর্ণিল নবাবগঞ্জ-Bornil Nobabgonj” নামের একটি পেজ থেকে এই ভিডিওটির বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে গত ২৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং এটি পেয়েছে ৭০-৮০ হাজার ইম্প্রেশন। অর্থাৎ ভিডিওটি ফেসবুকে দেখানো হয়েছে ৭০-৮০ হাজার মানুষকে। এছাড়াও, ভিডিওটি একাধিক ফেসবুক আইডি ও পেজ থেকে শেয়ার করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ভিডিওটির সবচেয়ে পুরোনো ভার্সনটি পাওয়া যায় ২০১৮ সালে (১, ২, ৩)। একই ভিডিও সেসময় ইউটিউবেও (১, ২) আপলোড করা হয়। এছাড়া সেসময়ে একাধিক সংবাদপত্রে (১, ২) এ সংক্রান্ত খবরও ছাপা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য সম্বলিত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে। তার প্রেক্ষিতে বিএনপির পক্ষ থেকে এমন ভিডিও প্রকাশের জন্য ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়। এছাড়া খালেদা জিয়ার প্রেস উইং থেকে এটিকে “বানোয়াট গল্প” বলেও দাবি করা হয়।
যাচাই করে দেখা গেছে একই ক্যাপশনে ভিডিওটি ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালেও ভাইরাল হয়েছিল। এছাড়া ভিন্ন ক্যাপশনে ভিডিওটি ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছরই শেয়ার হতে দেখা গেছে।
খালেদা জিয়ার আলোচ্য ভিডিওটি নিয়ে প্রথম ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেসবুকের থার্ড পার্টি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান বুম বাংলাদেশ। ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর লন্ডনের পার্ক প্লাজা রিভারব্যাংক হোটেলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর দলীয় অনুষ্ঠানে দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের একাধিক অংশ প্রেক্ষাপট ছাড়াই যুক্ত করা হয়েছে। এমনকি প্রযুক্তির সহায়তায় আলাদা শব্দ জুড়ে দেয়া হয়েছে ১৯ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে একই ভিডিও নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আরেকটি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান, ফ্যাক্টওয়াচ। তারাও এটিকে “বিকৃত ভিডিও” বলে সিদ্ধান্তে পৌছায়। উল্লেখ্য, ফ্যাক্টওয়াচও ফেসবুকের থার্ড পার্টি তথ্য যাচাইকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু ২০২১ সালে দুইবার যাচাই হওয়া সত্ত্বেও ২০২২ সালে ভিডিওটি আবার ফেসবুকে ছড়াতে দেখা যায়। এর প্রেক্ষিতে সে সময় ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন করে তৃতীয় আরেকটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান, রিউমর স্ক্যানার। তাদের পর্যবেক্ষণেও বলা হয়, “ভিডিওটিতে দুইটি আলাদা সময়ের বক্তব্য জুড়ে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে”।
অর্থাৎ বাংলাদেশের তিনটি ভিন্ন তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ২০২১ ও ২০২২ সালে একই ভুয়া ভিডিও নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু এরপরও নতুন করে ২০২৩ সালে আবারও ভিডিওটি প্রচার হতে দেখা যায় ফেসবুকে। তবে এর আগে ভিডিওটি শুধুমাত্র পোস্ট আকারে বিভিন্ন প্রোফাইল ও গ্রুপে শেয়ার করা হয়েছে। কিন্তু গত নভেম্বরে পোস্ট আকারে প্রকাশের পাশাপাশি সেটি বিজ্ঞাপন আকারেও ছড়ানো হয়েছে। যার ফলে ভিডিওটি আরও বেশি ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে গেছে।
সামাজিক মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের এমন বিকৃত ভুয়া বক্তব্যের প্রচার এই প্রথম নয়। কেবল খালেদা জিয়ার ভাষণ বিকৃত করে প্রচারের নমুনা রয়েছে আরো অন্তত দুটি। তার মধ্যে ২০২০ সালে খালেদা জিয়ার আলাদা একটি বিকৃত বক্তব্য নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বুম বাংলাদেশ। এবছরও খালেদা জিয়ার আরেকটি বিকৃত ভাষণ নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বুম বাংলাদেশ। এছাড়া, ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়েরও একটি ভাষণের ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে, যেটি পরবর্তীতে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে ‘বিকৃত’ বলে চিহ্নিত হয়।