তামারা ইয়াসমীন তমা
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিমানবন্দর লাউঞ্জ ব্যবহারের নথিটি ভুয়া
তামারা ইয়াসমীন তমা
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে ৫ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দোলনচাঁপা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের একটি তালিকা ছড়াতে দেখা গেছে। তালিকায় বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের নাম রয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ৫ আগস্ট পিটার হাস বাংলাদেশে ছিলেন এবং এই লাউঞ্জ ব্যবহার করে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তবে যাচাইয়ে সেখানে অন্তত পাঁচটি অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব; যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের তালিকার নথিটি ভুয়া।
ফেসবুকে বেশ কয়েকজন ব্যবহারকারী বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর নামসহ একটি ছবি (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬) শেয়ার করে দাবি করেন, ৫ আগস্ট পিটার হাস বাংলাদেশে ছিলেন এবং নিজের অবস্থান গোপন করেছেন।

পোস্টের সঙ্গে যুক্ত ছবির একদম উপরে “বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ” লেখার পাশে দেখা যাচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লোগো। আর দুই পাশে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা, “দোলনচাঁপা ভিআইপি- ২”, অর্থাৎ এটি দোলনচাঁপা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের তালিকা। ওই তালিকায় লাউঞ্জ ব্যবহারকারী কয়েকজন যাত্রীর বিবরণের সঙ্গে পিটার হাসের নাম ও বিবরণ দেখা যাচ্ছে।
আলোচিত তালিকাটি যাচাই করতে গিয়ে সেখানে থাকা তথ্যগুলো নিয়ে খোঁজ করে ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, তথ্যগুলোতে রয়েছে বেশকিছু অসঙ্গতি।

তালিকায় পিটার হাসের নামের পাশে উল্লেখ আছে ইমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ইকে-৫৮৩। ফ্লাইট অ্যাওয়ার এর তথ্যানুযায়ী, ৫ আগস্ট সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে ফ্লাইটটির নির্ধারিত ছাড়ার সময় ছিল। পরে বিলম্বে, সকাল ১০টা ৫২ মিনিটে ফ্লাইটটি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায় এবং প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর দুবাই পৌঁছে। কিন্তু ভিআইপি লাউঞ্জের তালিকায় পিটার হাসের নামের পাশে সময় দেওয়া হয়েছে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিট। অর্থাৎ, সকালে ছেড়ে যাওয়া ফ্লাইটের জন্য পিটার হাসের সন্ধ্যায় লাউঞ্জে অবস্থানের দাবিটি যুক্তিসংগত নয়।
অন্যদিকে, পিটার হাসের ফ্লাইট নম্বরের কাছাকাছি সময়ে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ইমিরেটসের আরেকটি ফ্লাইট ইকে-৫৮৭ ঢাকা থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার তথ্য খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। যদিও ফ্লাইটটি ৪২ মিনিট বিলম্বে ছেড়ে যায় ৮টা ১২ মিনিটে। ফলে সাবেক এই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের লাউঞ্জে অবস্থানের সময়, উল্লেখিত ফ্লাইটের নম্বর ও প্রকৃত ডিপারচার সময়— সবগুলো তথ্যই সাংঘর্ষিক।

তালিকায় ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের মধ্যে মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর নাম রয়েছে। সেখানে তাকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বলা হয়েছে। কিন্তু তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, তিনি ২০২২ সালেই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছেড়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।

নাম থাকা মো. রুহুল আলম সিদ্দিকীকেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বলা হয়েছে। অথচ ২০২৫ সালের ২২ মে তিনি ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পান এবং ২০ জুন থেকে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যান।
এছাড়া, তালিকায় অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক)-এর আইডি পারমিট শাখার সহকারী পরিচালক হিসেবে শাহরিয়ার চৌধুরীর নাম ও সাক্ষর দেখা যায়। তবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বর্তমানে এ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নাসিমা শাহীন। অর্থাৎ, সাক্ষরকারী কর্মকর্তার নাম নিয়েও তালিকায় অসঙ্গতি রয়েছে।
এসব ছাড়াও সেখানে পিটার হাসের পদবিতে ইংরেজিতে সাবেক রাষ্ট্রদূত (এক্স এ্যাম্বাসেডর) লেখা দেখা গেলেও সেখানে ইংরেজি বানানে ভুল পাওয়া যায়। আবার, সংস্থার নাম “বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ” লেখা থাকলেও সংস্থাটির প্রকৃত নাম “বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।”
অর্থাৎ, লাউঞ্জ ব্যবহাকারীদের এই তালিকাটি ভুয়া।

প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্টে, জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির দিনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাঁচ নেতা কক্সবাজার যান। তাদের এই আগমনকে ঘিরে তৈরি হয় নানা আলোচনা। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করতে কক্সবাজার গেছেন এই পাঁচ নেতা। তবে এনসিপির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমে বলেন, “পিটার হাসের সঙ্গে আমাদের কোনো মিটিং হয়নি। পুরোটাই গুজব ও প্রোপাগাণ্ডা। আমরা ঘুরতে এসেছি।”
এছাড়া আরেক সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বরাতে জানায়, কক্সবাজারে নয়, বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। আবার এনসিপি নেতারা যে হোটেলে অবস্থান করছেন সেখানকার কর্তৃপক্ষের বরাতে জানানো হয়, হোটেলটিতে পিটার হাস তো দূরের কথা, কোনো বিদেশি অতিথি নেই। বৈঠকের প্রশ্নই ওঠে না।