তৌহিদুল ইসলাম রাসো
ভুয়া বিজ্ঞপ্তিতে হাসনাতকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দাবি
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণ অঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকে নিয়ে একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। বিএনপির সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা হাসনাতের একাধিক ছবির সঙ্গে ছাত্রলীগের একটি প্যাডের ছবিও শেয়ার করেন যেখানে এই এনসিপির নেতাকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ সম্পাদক বলে মনোনীত করা হয়েছিল বলে জানানো হচ্ছে। যাচাইয়ে দেখা গেছে ২০২২ সালের ৩১ জুলাইয়ে স্বাক্ষরিত ছাত্রলীগের এই প্যাডটি ভুয়া। এর আগের একই তারিখে স্বাক্ষরিত প্যাড থেকে একাধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন পদে মনোনীত করার ছবি বিভিন্ন সময়ে ছড়াতে দেখা যায়। এছাড়া ২০২২ সালে প্রকাশিত এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের একজন নেতা জানান, ৩১ জুলাই তারিখে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির সবগুলোই ভুয়া।
ফেসবুকে গত ২৫ আগস্টে রুমিন ফারহানার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে হাসনাতকে নিয়ে পোস্ট করা হয়। পোস্টে থাকা মোট পাঁচটি ছবির চারটিতে হাসনাত আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমনটি বোঝানো হচ্ছে। আর শেষ ছবিতে ৩১ জুলাই ২০২২ তারিখে স্বাক্ষরিত ছাত্রলীগের এক প্যাডে হাসনাতকে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক মনোনীত করা হয়েছে বলে জানানো হচ্ছে।
রুমিন ফারহানার সেই পোস্টটি এখন পর্যন্ত ২১ হাজারের বেশিবার শেয়ার করা হয়েছে এবং ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি ব্যবহারকারী সেখানে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

ছাত্রলীগের সেই প্যাডের ছবির সত্যতা জানতে অনলাইনে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখে ডিসমিসল্যাব। সার্চে ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের একটি ফেসবুক পোস্টে একই প্যাডের ছবি খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে হাসনাতকে ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক বলে মনোনীত করা হয়। এছাড়া পোস্টটিতে এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলমকেও একই পদে মনোনীত করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
একই প্যাডের আরও কিছু ছবি (১, ২) পাওয়া যায় অনলাইনে। ২০২২ সালে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে পোস্ট করা সেই ছবিগুলোর একটিতে ব্রাজিলের ফুটবলার নেইমার জুনিয়রকে সহ সম্পাদক এবং আর্জেন্টাইন তারকা ফুটবলার লিওনেল মেসিকে সহ সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। ছবিগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসবের সঙ্গে বর্তমানে ছড়ানো প্যাডের লেখায় হুবহু মিল রয়েছে। এছাড়া প্যাডে স্বাক্ষরিত তারিখেও হুবহু মিল আছে। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রায় ৩ বছর আগেও একই তারিখের প্যাডে ভিন্ন ব্যক্তিদের নাম সম্পাদনা করে বসানো হয়েছে।

এছাড়া মেসি-নেইমারের ছাত্রলীগে পদ পাওয়ার এই প্যাডের ছবি নিয়ে সে সময়ে সংবাদমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনও খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সে সময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটিতে গণহারে পদ দেওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে মেসি ও নেইমারকে পদ দেওয়ার প্যাড বানানো হয়েছে বলে দাবি করছেন অনেকে।
ছাত্রলীগের এই সম্পদিত কার্ড সম্পর্কে আরও জানতে অনলাইনে কিছু প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড ধরে সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। এতে সামনে আসে জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোরে ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। “ভুয়া বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় কমিটির ‘সদস্য’ দাবি ছাত্রলীগ নেত্রীর” শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, “ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির ছবি যুক্ত করে ফেসবুকে নিজেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ‘সদস্য’ বলে প্রচার করার অভিযোগ উঠেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) ছাত্রলীগের এক নেত্রীর বিরুদ্ধে।” বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে শামসুন নাহার কাকলীকে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। তবে ওই নেত্রীর পদ পাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছেন সংগঠনটির তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম খান শিমুল। তিনি বলেন, ওই তারিখে আমাদের কোনো সদস্য ইস্যু করা হয়নি। গত ৩১ জুলাইয়ের যতগুলো বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে তার সবগুলোই ভুয়া।
প্রতিবেদনে ভুয়া সেই প্যাডের ছবিও দেখা যায়। ছবিটি যাচাইয়ে দেখা যায়, শুধু নাম ও পদবীর জায়গা ছাড়া সেখানে থাকা বাকি সব লেখা বর্তমানে হাসনাতকে জড়িয়ে ছড়ানো প্যাডের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, একই ভুয়া প্যাড সম্পাদনা করে সেখানে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তিকে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে অসত্যভাবে মনোনীত করা হয়েছে। কখনো সেটি ব্যাঙ্গাত্মকভাবে আবার কখনো সেটি প্রকৃত বিজ্ঞপ্তি দাবিতে।

সম্পাদিত প্যাডে থাকা তারিখ নিয়েও যাচাই করে দেখে ডিসমিসল্যাব। জানা যায় ৩১ জুলাই ২০২২ তারিখে ছাত্রলীগের কোনো কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা করা হয়নি কিংবা বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি। তবে এই তারিখে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের ২৪ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোঘণা করা হয় বলে জানা যায় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে।
এছাড়া, যাচাইয়ে দেখা যায় ২০২২ সালের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল ২০ ডিসেম্বর। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই। পূর্ণাঙ্গ সেই কমিটির তালিকায় হাসনাত আবদুল্লাহের নাম ছিল কি না সেটিও খুঁজে দেখে ডিসমিসল্যাব। দেখা যায় সেই তালিকায় “হাসনাত” বা “হাসনাত আবদুল্লাহ” নামের কোনো ব্যক্তির নাম নেই। এছাড়া হাসনাতের মূল নাম “মো. আবুল হাসনাত” নামেরও কোনো ব্যক্তির নাম নেই সেই তালিকায়।
অর্থাৎ, হাসনাত আবদুল্লাহর ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক পদে মনোনীত করার ছাত্রলীগের প্যাডটি সম্পাদিত। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করে একাধিক ব্যক্তিকে অসত্যভাবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক পদে মনোনীত করার ঘটনা ঘটেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের শুনানিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে এনসিপির নেতাদের ধাক্কাধাক্কি ও মারধরের ঘটনা ঘটে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানাও। এরপর ঘটনাটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে এসে রুমিন ফারহানাকে “বিএনপির আওয়ামী লীগবিষয়ক অন্যতম সম্পাদক” বলে উল্লেখ করেন হাসনাত। ঠিক পরের দিন, হাসনাতকে নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে আলোচিত পোস্টটি করেন এই বিএনপি নেত্রী।