ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
জাতিসংঘের লোগোযুক্ত ইনফোগ্রাফের দাবিটি ভুয়া

জাতিসংঘের লোগোযুক্ত ইনফোগ্রাফের দাবিটি ভুয়া

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রসঙ্গে একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনের সময়জুড়ে প্রায় ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এরপর ফেসবুকে কিছু পোস্ট ছড়াতে দেখা যায়, যেখানে জাতিসংঘের লোগোযুক্ত একটি ইনফোগ্রাফের মাধ্যমে দাবি করা হয় যে, নিহত ১৪০০ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। নিহতের এই বিবরণে দাবি করা হয় সবচেয়ে বেশি, ৭৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে ৭ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে এ ধরনের কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। বরং সেখানে বলা হয়েছে, এই ১৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে। ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৪৪ জন সদস্য নিহত হয়েছেন বলেও ওএইচসিএইচআরকে জানানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তবে সেগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের সহযোগী এই সংস্থার প্রতিবেদনে।

ফেসবুকে “জেন-জি আওয়ামী (Gen- Z Awami)” নামের একটি পেজ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি একটি ইনফোগ্রাফ বা ছবি শেয়ার করা হয়। ফেসবুকে একই ধরনের বেশকিছু পোস্ট (, , ) খুঁজে পাওয়া যায়। একই ইনফোগ্রাফ ছড়াতে দেখা গেছে এক্সেও (, , )। ছবিটির একপাশে লেখা, “বাংলাদেশে জুলাই মাসের দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা।” অন্যপাশে জাতিসংঘের (UN) লোগো ব্যবহার করা হয়েছে, যা দেখে মনে হতে পারে এটি জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি। ছবির নীচে একটি টেবিলের মাধ্যমে জুলাই থেকে আগস্টের তিনটি আলাদা সময়ের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা এবং ভুক্তভোগীদের ধরন দেখানো হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বরাতে প্রকাশিত এই ইনফোগ্রাফে দাবি করা হয়েছে যে—জুলাই ১ থেকে আগস্ট ৪ পর্যন্ত অভ্যুত্থানে ৪০০ জন নিহত হন। ভুক্তভোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয় “দাঙ্গাকারী”, “আওয়ামী লীগ সমর্থক” এবং “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য”। আগস্ট ৫-৬ সময়ে দেখানো হয়েছে ২৫০ জন নিহতের সংখ্যা। এসময়ও নিহতদের ক্ষেত্রে একই তিন গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হয়। সবশেষে, ৭ থেকে ১৫ আগস্ট সময়পর্বে মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৭৫০। তবে এ পর্যায়ে ভুক্তভোগীদের তালিকায় দেখানো হয়েছে শুধু “আওয়ামী লীগ সমর্থক” ও “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের” নাম। তিনটি সময়পর্বে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪০০। এই দাবি অনুসারে, পুরো অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ৭ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে, যার ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগ সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

ইনফোগ্রাফের ক্যাপশনে ইংরেজিতে লেখা হয়, এটি বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে মৃত্যুর সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান! আরও লেখা হয়, “যদি আগস্ট ৫-এর আগে নিহতদের জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী হয়, তবে আগস্ট ৫-এর পর নিহতদের জন্য দায়ী কে? এই সহজ প্রশ্নের উত্তর মানবাধিকার কমিশনের দেওয়া উচিত।”

দাবিটি যাচাইয়ের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত মূল ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনটি খতিয়ে দেখেছে ডিসমিসল্যাব। মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনটির শিরোনাম “জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন: বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের আন্দোলন সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন।” প্রতিবেদনের ৫৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অন্তত ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ১২-১৩% শিশু এবং অন্তত ১৩ জন নারী ছিলেন।

তবে আন্দোলনে নিহতের মোট সংখ্যা ছাড়া ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে বাকি দাবিগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়নি। প্রথমত, ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে “বাংলাদেশে জুলাই মাসের দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা” দাবিতে আলোচিত ইনফোগ্রাফটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেদনের ৫৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৫ জুলাই–৫ আগস্ট পর্যন্ত অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা ১৪০০, প্রতিবেদনের এই সংখ্যা ইনফোগ্রাফে একই থাকলেও সময়পর্বে দেখানো হয় ১৫ আগস্ট পর্যন্ত; যা সঠিক নয়। তৃতীয়ত, নিহতদের পরিচয় সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে “দাঙ্গাকারী” (Rioters), “আওয়ামী লীগ সমর্থক” (AL Supporters), বা “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য” (Law Enforcement Personnels) এই শব্দগুলোর কোন উল্লেখ নেই। বরং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের ১৩০টি মৃত্যুর ফরেনসিক তথ্যের বরাতে বলা হয়েছে, আন্দোলনে ৭৮% মৃত্যু ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে, এবং ৬৬% নিহত হয়েছেন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক রাইফেলের গুলিতে, যা মূলত বিজিবি, র‍্যাব, সেনাবাহিনী, আনসার/ভিডিপি ব্যাটালিয়ন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের ব্যবহৃত অস্ত্র। 

ওএইচসিএইচআরের অনুসন্ধান বলছে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তৎকালীন সরকার, এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামো, এবং আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীগুলো সম্মিলিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

এছাড়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত একাধিক প্রতিশোধমূলক সহিংসতার তথ্য প্রতিবেদনের ২১১ থেকে ২৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানকার ২২২ ও ২২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত প্রতিশোধমূলক সহিংসতার প্রকৃত মাত্রা, বিশেষ করে পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের কোনো নিরপেক্ষ হিসাব দিতে পারেনি ওএইচসিএইচআর।

তবে আওয়ামী লীগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এ সময়ে দলটির ১৪৪ জন নেতা-কর্মী ও সহযোগী সংগঠনের সদস্য নিহত হয়েছেন। আর বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে পুলিশের ৪৪ জন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তিনজন, আনসার-ভিডিপির তিনজন এবং র‍্যাবের দুইজন সদস্য নিহত হন। যদিও ওএইচসিএইচআর স্বাধীনভাবে এসব তথ্য যাচাই করতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরো কিছু লেখা