তনিমা আক্তার জীম
মাহফুজা খানম নন, ডাকসুর প্রথম নারী ভিপি ছিলেন বেগম জাহানারা আখতার
তনিমা আক্তার জীম
অধ্যাপক মাহফুজা খানমকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) একমাত্র বা প্রথম নারী সহ-সভাপতি (ভিপি) দাবি করে সম্প্রতি দেশের একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। তবে তৎকালীন পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন বইয়ের তথ্য যাচাইয়ে দেখা যায় দাবিটি সঠিক নয়। ডাকসুতে প্রথম নারী ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম জাহানারা আখতার ১৯৬০–৬১ শিক্ষাবর্ষে; এরপর ১৯৬৭–৬৮ শিক্ষাবর্ষে ভিপি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মাহফুজা খানম। অর্থাৎ, মাহফুজা খানম ‘প্রথম’ নারী ভিপি ছিলেন না, তার অন্তত সাত বছর আগেই বেগম জাহানারা ডাকসুর ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নারী ভিপি মাত্র একজনই ছিলেন- এ দাবিটিও সত্য নয়।
চলতি মাসের ১২ তারিখ ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সংবাদ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বেশকিছু প্রতিবেদনে তাঁকে ডাকসুর একমাত্র বা প্রথম নারী ভিপি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬)। “ডাকসুর একমাত্র নারী ভিপি মাহফুজা খানম আর নেই” — শিরোনামে প্রকাশিত কালের কণ্ঠের সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি ছিলেন ডাকসুর একমাত্র নারী ভিপি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।” প্রথম আলো ইংরেজির অনলাইন সংস্করণে বলা হয়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রাক্তন সহ-সভাপতি মাহফুজা খানম, যিনি এই পদে অধিষ্ঠিত একমাত্র নারী, মঙ্গলবার মারা গেছেন।” বাংলাদেশ প্রতিদিন “ডাকসুর একমাত্র নারী ভিপি মাহফুজা খানম আর নেই” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করেন। একটি প্রোফাইল থেকে পুরোনো একটি পেপার কাটের ছবি শেয়ার করে লেখা হয়, “ছবিতে প্রোপাগান্ডা এবং অপরাজনীতির ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ডাকসুর প্রথম নারী ভিপি বেগম জাহানারা আখতার, ফেব্রুয়ারী ১৯৬১ সালে নবনির্বাচিত ডাকসু ভিপি হিসেবে বক্তৃতা করছেন।”
ছবিটি নিয়ে অনলাইন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২২ সালে সালাউদ্দিন দোলক নামের প্রোফাইল থেকে ছবিটি প্রথম ফেসবুকে শেয়ার করা হয়। ছবিতে সালাহউদ্দিন আর্কাইভ লেখা জলছাপ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে “সালাহউদ্দিন আর্কাইভ” নামে একটি ফেসবুক পেজও পাওয়া যায়। পেজ থেকে সালাউদ্দিন দোলকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবিটির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসমিসল্যাবকে তিনি জানান, পত্রিকার পেপার কাটিং থেকে তিনি ছবিটি শেয়ার করেছিলেন। ডিসমিসল্যাবকে তিনি জাহানারা বেগমের ছবিসহ মূল পত্রিকার ছবিও তুলে দেন। ১৯৬১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি “দ্য পাকিস্তান অবজারভার” পত্রিকার ৮নং পাতায় ছবিটি প্রকাশিত হয়।

ডিসমিসল্যাব সংগ্রামের নোটবুক ওয়েবসাইট থেকে দ্য পাকিস্তান অবজার্ভারের ১৯৬১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির ই-কপিটি যাচাই করেও ছবিটি দেখতে পায়। নবনির্বাচিত ডাকসু সদস্যদের অভিষেক অনুষ্ঠানে তোলা পাশাপাশি তিনটি ছবির মাঝের ছবিতে শাড়ি পরিহিত একজনকে ডায়াসে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এর ক্যাপশনে লেখা, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান (বাম থেকে ডানে) উপাচার্য ড. মাহমুদ হুসেন সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন: ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মিস জাহানারা আখতার তার উদ্বোধনী ভাষণ পাঠ করছেন; একটি যুগল নৃত্য পরিবেশনা।”
জাহানারাকে নিয়ে সে সময়ের আরও বিস্তারিত তথ্য পেতে ১৯৬১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার কপিগুলোও যাচাই করে ডিসমিসল্যাব।
দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ১৯৬১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় পাতায় প্রকাশিত একটি সংবাদে বেগম জাহানারা আখতারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম নারী সহ-সভাপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম একজন ছাত্রী কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। নবনির্বাচিত ভাইস-প্রেসিডেন্ট জাহানারা বেগম বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, “তিনি ও তাঁহার ইউনিয়ন সহযোগিগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ শিক্ষামূলক আবহাওয়া গড়িয়া তুলিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন।”

এছাড়া তৎকালীন ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দ্য মর্নিং নিউজের ১৭ ফেব্রুয়ারি “সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান। প্রজ্ঞাভিত্তিক/বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশের প্রসার ঘটাতে আবেদন করলেন ভিসি” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “এই বছর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের কমিটি গঠনে একটি বিশেষ দিক ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী শিক্ষার্থী সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। উইমেন্স হলের মিস জাহানারা বেগম হলেন নবনির্বাচিত সহ-সভাপতি।” প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান রোকেয়া হলের পূর্ব নাম ছিল উইমেন্স হল।

জাহানারা আখতারের নামের উল্লেখ পাওয়া যায় তৎকালীন পত্রিকা দৈনিক সংবাদেও। ১৯৬১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, “হত্যাকারীদের শাস্তি চাই: ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিবৃতি”। কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট প্যাট্রিস লুমুম্বার হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করে বিভিন্ন ছাত্রনেতা বিবৃতি দেন, যেখানে বিবৃতি দানকারীদের মধ্যে বেগম জাহানারা আখতারকে ডাকসুর সহ-সভানেত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

পত্রিকাগুলোর বাইরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র নামের বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে জাহানারা আখতারের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখান থেকে জানা যায়, বেগম জাহানারা আখতার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন।
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘শহিদ দিবস’ পালন করা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের দলিলটিতে শহিদ দিবস পালন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ থাকতে দেখা যায়। বইটির ৮১ পৃষ্ঠায় বলা হয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বক্তৃতা দেন। এরপর একই সংগঠনের এ. কে. এম. জিয়াউদ্দিন পুলিশের গুলিতে নিহত বরকতের মা-বাবার কাছে পাঠানোর উদ্দেশ্যে লেখা একটি বার্তা পাঠ করেন। তারপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি জাহানারা আখতার একটি রেজুলেশন পাঠ করেন।
বইটির ৮২ পৃষ্ঠায় ১৪ নং পয়েন্টে শহিদ দিবস পালনে অগ্রণী নেতৃত্ব এবং সংগঠক হিসেবে ১৩ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয় যেখানে ৭ নং ব্যক্তিটি ছিলেন বেগম জাহানারা আখতার। তার নামের পাশে তাকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ডাকসু সংগ্রহশালার “সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নামের তালিকা” শীর্ষক সম্মাননা কাষ্ঠফলকেও ১৯৬০-৬১ শিক্ষাবর্ষে সহ-সভাপতি হিসেবে হিসেবে বেগম জাহানারা আখতারের নাম লিখিত রয়েছে। যদিও বেগম জাহানারা আখতার এর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আর তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, ১৯৭০ সালে ডাকসুর নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন হয়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতো পরোক্ষ পদ্ধতিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং প্রক্টর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী এক কলামে লিখেন, ১৯৬৮–৬৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ডাকসুতে পরোক্ষ নির্বাচন চলত যেখানে পদগুলো আগেই হলভিত্তিক বণ্টন হতো এবং বছরভিত্তিক রোটেশন ছিল। বেগম জাহানারা আখতার এবং মাহফুজা খানম দুজনেই পরোক্ষ পদ্ধতিতে ডাকসু ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, তৎকালীন পত্রিকা অনুসারে ১৯৭০ সালের ১৬ মে (১, ২) সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরাসরি ভোটদানের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।
অর্থাৎ অধ্যাপক মাহফুজা খানমকে ডাকসুর একমাত্র বা প্রথম নারী ভিপি হিসেবে সম্বোধন করা বিভ্রান্তিকর। বেগম জাহানারা আখতার ছিলেন ডাকসুর প্রথম নারী ভিপি।