তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভুয়া ছবি দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্রের সমালোচনা
This article is more than 12 months old

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভুয়া ছবি দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্রের সমালোচনা

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যাওয়ার একাধিক ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিগুলো পোস্ট (, , , , , , , , , ১০) করে দাবি করা হচ্ছে, ট্রাম্পকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পোস্টগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ছবিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টুল ব্যবহার করে তৈরি এবং এগুলো আগেও ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে। 

ট্রাম্পকে আটক করার ছবি দিয়ে একজন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের নমুনা! দেশটির একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে সেই দেশেটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে! তারা আবার গণতন্ত্র শেখাতে আসে! পুরো পৃথিবী জুড়ে সবচেয়ে খারাপ এবং সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত আমেরিকা। গণতন্ত্রের টুটিকে চেপে ধরার রাষ্ট্রের মুখে গণতন্ত্র কতটুকু শোভা পায় বিশ্ববাসীর কাছে আজ তা বিদ্যমান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নাক গালানো আমেরিকার জন্মগত স্বভাব, যে গণতন্ত্রের ফুলছড়ি তাদের মুখে শোনা যায় প্রকৃত অর্থে কিঞ্চিৎ মাত্র গণতন্ত্র তাদের দেশে নেই।”

আরেকটি পোস্টে লেখা, “আমেরিকার গণতন্ত্র! একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে টেনেহিঁচড়ে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে! বাংলাদেশে একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতাবলে ৪০১ ধারা অনুযায়ী বাসায় থাকতে দিয়েছে। অথচ তারা আমাদের দেশে গণতন্ত্র শেখাতে আসে। আজব হিপোক্রেসি।”

আরেকজন লিখেছেন, “#সাম্রাজ্যবাদী #আমেরিকা আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার আগে নিজেদের আচরণ নিয়ে চিন্তা করা দরকার!!! আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে তোমাদের মাতব্বরি এ দেশের আত্ম মর্যাদাবান মানুষ গুলো কখনো মেনে নিবে না।”

সবগুলো পোস্টেই একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম ছবিতে দেখা যায় ট্রাম্পকে ধরার চেষ্টা করছেন কয়েকজন পুলিশ। দ্বিতীয় ছবিটিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পড়ে যাচ্ছেন, এবং তাকে ধরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

প্রকৃতপক্ষে এই ছবি দুটো সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক স্বাধীন গবেষণা ল্যাব মিডজার্নি ইনকরপোরেশনের এআই ইমেজ জেনারেটর সফটওয়্যার, মিডজার্নিতে তৈরি করা। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গ্রেপ্তারের এই ছবিগুলো ছাড়াও বিগত কয়েক মাসে মিডজার্নিতে তৈরি পোপ ফ্রান্সিসের পাফার জ্যাকেট পরা ছবি এবং ইলন মাস্কের রোবট স্ত্রীর ছবি ভাইরাল হয়। 

মূলত ওপেন সোর্স ইনভেস্টিগেটিভ প্লাটফর্ম বেলিংক্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়ট হিগিন্স মিডজার্নির সাহায্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ছবিগুলো তৈরি করে টুইট করেন। ক্যাপশনে লিখেন “ট্রাম্পের গ্রেপ্তারের অপেক্ষায় বসে থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করার ছবি বানাচ্ছি”। তবে ছবিগুলো ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুহূর্তের মধ্যেই ওয়াশিংটন ডিসিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রেপ্তারের সংবাদ প্রচার করে ভুয়া তথ্য ছড়াতে শুরু করে। একাধিক গণমাধ্যম (, , ) ছবিগুলো যাচাই করে সিদ্ধান্ত জানায় যে, এগুলো এআই নির্মিত ছবি।

পরবর্তীতে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ছবিগুলোর নির্মাতা ইলিয়ট হিগিন্স জানান, “আমি শুধু মজা করছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো পাঁচজন মানুষ এটা রিটুইট করবে।” ছবিগুলো তৈরির জন্য তিনি মিডজার্নিকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন এভাবে: “গ্রেপ্তারের সময় পড়ে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প”। মিডজার্নি সেই অনুযায়ী ছবিগুলো তৈরি করে দেয়। একইভাবে তিনি কারাবন্দী পুতিনের ছবিও তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন। 

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এআই নির্মিত ছবির মাধ্যমে অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা দেখা গেছে। 

গত ১০ মে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করার একদিন পর তাঁর কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থার একটি ছবি ভাইরাল হয়, যেটি তৈরি করা হয়েছিল এআইয়ের সাহায্যে। ফ্যাক্টচেকে দেখা যায় ছবিটি মিডজার্নি এআই সফটওয়্যার দিয়ে বানানো হয়েছিল। একই মাসে ইমরান খানের সমর্থনে আন্দোলনের আরও কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়, যেগুলোর এআই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে জানায় একাধিক গণমাধ্যম

শুধু ছবিই না, সম্প্রতি এ ধরনের ভুয়া ভিডিও-ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। গত জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি ডিপফেক ভিডিও সামনে আসে, যেখানে ভয়েস সিমুলেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁর ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠাতে বলার একটি ভিডিওকে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণের ভিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়। 

সাম্প্রতিক এসব ঘটনার পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি অপতথ্য নির্বাচনের সময় গুরুতর ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওপেন এআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান কংগ্রেসের এক শুনানিতে বলেন, এই এআই মডেলগুলোর মানুষকে প্রভাবিত ও প্ররোচিত করার ক্ষমতা রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের অ্যালান টিউরিং ইন্সটিটিউটের ফাউন্ডেশন এআই রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক মাইকেল উলড্রিজ গার্ডিয়ানকে জানান, প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর মূল উদ্বেগ হলো এআই-চালিত অপতথ্য। 

অধ্যাপক উলড্রিজ আরো বলেন, “এই মুহূর্তে এআইভিত্তিক অপতথ্য আমার উদ্বেগের জায়গাগুলোর তালিকায় প্রথমে আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে এবং আমরা জানি যে সোশ্যাল মিডিয়া ভুয়া তথ্য ছড়ানোর একটি শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু এখন আমরা এটাও জানি যে, এআই আরও অনেক বড় আকারে অপতথ্য তৈরি করতে পারে।”

আরো কিছু লেখা