তৌহিদুল ইসলাম রাসো
চট্টগ্রামে যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) ভুয়া দাবিতে একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় একদল বিক্ষোভকারীর সংঘর্ষের ঘটনার কয়েকটি ভিডিও-ছবি পোস্ট করে বলা হচ্ছে সংঘর্ষে ৫০ জনের বেশি হিন্দু মারা গেছেন এবং কমপক্ষে ৬ জন হিন্দু নারী ও মেয়েকে অপহরণ করেছে উগ্রবাদী ইসলামপন্থীরা। তবে যাচাইয়ে চট্টগ্রামের এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত কারও মারা যাওয়ার বা অপহরণের খবর পাওয়া যায়নি এবং এখানে জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো ইসলামপন্থী দলের জড়িত থাকারও কোনো প্রমাণ মেলেনি।
‘বাবা বানারস’ নামের এক্সের একটি ভেরিফায়েড প্রোফাইল থেকে গত ৬ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানের ৩টি ভিডিও ও একটি ছবি শেয়ার করে বিবরণীতে লেখা হয়, “দুঃখজনক। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাসীদের যৌথ হামলায় ৫০ জনেরও বেশি হিন্দু নিহত ও আহত হয়েছে। অন্তত ৬ জন হিন্দু নারী ও মেয়েকে উগ্র ইসলামপন্থীরা অপহরণ করেছে। পুরো বিশ্ব নিশ্চুপ। ঘুমাচ্ছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও।” এছাড়া হ্যাশট্যাগে #সেভবাংলাদেশীহিন্দুজ লেখা দেখতে পাওয়া যায়। তারপরে একই বিবরণীতে ফেসবুকেও ভিডিও ছড়াতে দেখা গেছে।
এখন পর্যন্ত এক্স এ পোস্টটি দেখেছেন প্রায় ৫৫ হাজার ব্যবহারকারী। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রায় চার হাজার জন, পুনরায় পোস্ট করেছেন তিন হাজারের বেশি ব্যবহারকারীও। আর মন্তব্য করেছেন প্রায় ৩০০ জন। মন্তব্যের ঘরে এক ব্যবহারকারী ইংরেজিতে লিখেছেন, “বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য পরিস্থিতি খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এবং ভারতের উচিত তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার কথা শোনা। সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন ঠিক নয়।” আরেক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “পুরো বিশ্ব নীরব। কিন্তু ভারত এত চুপ কেন?” আবার আরেক ব্যবহারকারী ঘটনাটিকে ফেক নিউজ বলে ঘটনার উৎস চেয়ে লিখেছেন, “কেউ নিহত হয়নি! ভুয়া খবর ছড়ানো বন্ধ করুন। আপনি ঘটনার সোর্স দেখাতে পারবেন?”
প্রকৃত ঘটনার খোঁজে অনলাইনে আলাদা করে রিভার্স ইমেজ এবং কীওয়ার্ড সার্চ করে দেখে ডিসমিসল্যাব। মূলধারার গণমাধ্যমের একটি ভিডিও প্রতিবেদনের সঙ্গে এক্সে শেয়ার করা এক ফুটেজের হুবহু মিল পাওয়া যায়। পোস্টের দ্বিতীয় ভিডিওর সঙ্গে যমুনা টেলিভিশনের এই ভিডিও প্রতিবেদনের ২ মিনিটের পর থেকে মিল দেখা যায়। আর বাকি দুটি ভিডিও শেয়ার করা একাধিক পোস্ট (১, ২) পাওয়া যায় ফেসবুকে, যেগুলো এক্সের করা পোস্টের অনেক আগে থেকেই আছে। আর একমাত্র ছবিটির সঙ্গে এই ভিডিওর ৪০তম সেকেন্ডের যে দৃশ্য তার মিল পাওয়া যায়।
যমুনা টেলিভিশনের ইউটিউব ভিডিও প্রতিবেদনের বিবরণী থেকে জানা যায়, গত ৫ নভেম্বর, ফেসবুকে পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরী হয় চট্টগ্রামের হাজারী গলি এলাকায়। এক মুসলিম ব্যবসায়ী হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের বিরুদ্ধে পোস্ট করলে এই পরিস্থিতি তৈরী হয়। সেই মুসলিম ব্যবসায়ীকে অবরুদ্ধ করে রাখে কিছু বিক্ষোভকারী। আর ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করতে গিয়ে হামলার শিকার হয় যৌথবাহিনী। এতে আহত হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ১৩ সদস্য। এরই প্রেক্ষিতে অপরাধীদের ধরতে রাতভর অভিযান পরিচালনা করে যৌথবাহিনী। আটক করা হয় ৮২ জনকে। একই বক্তব্য দেখা যায় একাধিক গণমাধ্যমের (১, ২, ৩, ৪) প্রতিবেদনে। কিন্তু সেসব প্রতিবেদনে কোনো মৃত্যু বা অপহরণের খবর পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামের হাজারী গলির হতাহতের ঘটনা নিয়ে আরো জানতে কীওয়ার্ড সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনে (১, ২) একই ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়, চট্টগ্রামে ইসকন নিয়ে ফেসবুকে অন্যের একটি পোস্ট শেয়ার করেন ব্যবসায়ী ওসমান আলী। এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে হাজারী গলির মিয়া শপিং সেন্টারে তাঁর দোকানে হামলা করে বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথবাহিনী গেলে তাদের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের অন্তত ১২ সদস্য আহত হন। আর রাতে অভিযান চালিয়ে ৮২ জনকে আটক করা হলেও যাচাই-বাছাই শেষে ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে যৌথবাহিনীর সদ্যস্যদের আহতের উল্লেখ থাকলেও ইসকন সমর্থকদের হতাহত নিয়ে কিছু জানানো হয়নি। এ সম্পর্কে জানতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক স্বতন্ত্র গৌরঙ্গ দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, “মৃত্যুর এই সংখ্যাটি একেবারেই ভুয়া। এখন পর্যন্ত হাজারি গলি সংঘর্ষে কোনো মৃত্যুর খবর আমি পাইনি।” আর বিস্তারিত বলতে গিয়ে তিনি জানান, শুরুতে যৌথবাহিনীর উপর হামলা হলে পরবর্তীতে রাতে তারা অভিযান চালায়। অভিযানে সেখানকার হিন্দুদের উপর নির্বিচারে হামলা চালানো হয়। আর এতে আসল অপরাধীদের সঙ্গে সাধারণ হিন্দুরাও আহত হয়। তার জানামতে প্রায় ৪৫ জন হিন্দু আহত হয়েছেন। আর আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও জানান তিনি।
এছাড়া দুটি আলাদা গণমাধ্যমের চট্টগ্রাম প্রতিনিধির সঙ্গেও যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জোবায়ের চৌধুরী বলেন, “ছড়িয়ে পড়া তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুয়া। এই ঘটনায় কেউ মারা যাননি। আর এখানে জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পৃক্ততাও নেই।” আরেক গণমাধ্যম বাংলানিউজ২৪ এর স্থানীয় প্রতিনিধিও একই কথা জানান ডিসমিসল্যাবকে।
ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে যৌথবাহিনীর পক্ষে টাস্কফোর্স-৪-এর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান এগুলো একদমই মিথ্যা তথ্য। এই ঘটনায় কেউ মারা যায়নি। যৌথ বাহিনীর ১২ জন আহত হয়েছেন। আর জামায়াতের জড়িত থাকার প্রসঙ্গে বলেন, “এখানে যারা জড়িত ছিল তারা জামায়াত বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, বরং দুষ্কৃতকারী।”
তাই, চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের বলে ছড়ানো ভিডিওগুলো আসল হলেও নিহত বা অপহরণের দাবিটি ভিত্তিহীন। উক্ত সংঘর্ষে মারা যাবার কোনো ঘটনা ঘটেনি।