তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
আওয়ামী লীগের হরতাল দাবিতে ছড়ালো যেসব অপতথ্য

আওয়ামী লীগের হরতাল দাবিতে ছড়ালো যেসব অপতথ্য

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ১৬ মার্চের সংঘর্ষে প্রাণ হারান অন্তত পাঁচজন। এই ঘটনাকে “গণহত্যা” আখ্যা দিয়ে এর প্রতিবাদে ২০ জুলাই হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো। আর এই দিনে হরতাল পালনের কর্মসূচি দাবিতে ফেসবুকে ছড়াতে দেখা যায় বেশকিছু পুরোনো ভিডিও। পুরোনো ফুটেজে বিভ্রান্ত হয় গণমাধ্যমও। ঘটনাবহুল এই দিনে অন্তত চারটি ভিডিও যাচাই করে ডিসমিসল্যাব।

১ম ভিডিও

২০ জুলাই সকালে আওয়ামী সমর্থিত কয়েকটি ফেসবুক প্রোফাইল (, , ) থেকে ৩৮ সেকেন্ডের হুবহু একই ভিডিও শেয়ার করে বলা হয় এটি সিলেটে আওয়ামী সমর্থকদের হরতাল পালনের দৃশ্য। হুবহু একই ক্যাপশনে বলা হচ্ছে, “সকালে,ভোর ৫ টায়, সিলেটে দেশপ্রেমিক জনগণ আওয়ামী লীগের, কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে,,হরতাল পালন করতেছেন।।”

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোর কিফ্রেম ধরে অনলাইনে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায়, ভিডিওগুলো সাম্প্রতিক সময়ের নয়, বরং প্রায় দুই বছর আগের। মূল ঘটনাটি ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বরের। সেই সময়ে সিলেটের সুবিদবাজারে বিএনপির ডাকা অবরোধের সমর্থনে মশালমিছিল ও যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনার দৃশ্য এটি। অর্থাৎ, বিএনপির একটি পুরোনো কর্মসূচির ভিডিও ছড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের হরতাল দাবিতে।

এই একই ভিডিও একাধিক ভুয়া দাবিতে এর আগেও ছড়ানো হয়েছে, যা নিয়ে ইতোমধ্যে অন্তত দুটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডিসমিসল্যাব। প্রথম ভুল দাবিটি ছিল ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগের দিনে। সেদিন ফেসবুক পোস্টে ভিডিওটি শেয়ার করে বলা হয় এটি ঢাকার ঘটনা। তবে দাবিটিকে ভুল প্রমাণ করে ওই সময়ে যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। ভিডিওটি পুনরায় ভিন্ন দাবিতে ছড়ায় চলতি বছরের এপ্রিলে। কোথাও বলা হয় এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার দৃশ্য; আবার কোথাও দাবি করা হচ্ছে এটি ভারতে হিন্দুদের বাড়ি, দোকানপাটে আগুন দেওয়ার দৃশ্য। সেই সময়েও এ নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। 

২য় ভিডিও

ফেসবুকে আওয়ামী সমর্থিত বেশ কয়েকটি প্রোফাইল (, , ) থেকে অপর একটি ভিডিও শেয়ার করা হচ্ছে কুমিল্লায় হরতাল পালনের দৃশ্য দাবিতে। ৪৮ সেকেন্ডের হুবহু একই ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে অভিন্ন বিবরণে। ফেসবুক পোস্টের বিবরণে দাবি করা হচ্ছে– কুমিল্লায় শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের সময় আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর হামলা চালায় পুলিশ।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে রাস্তায় মিছিলরত একদল মানুষের উপর লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করছে পুলিশ। ভিডিওর উপরের দিকে ডান পার্শ্বে “জাগরণী টিভি” লেখা এবং একটি লোগো দেখতে পাওয়া যায়। এরই সূত্র ধরে ফেসবুকে “জাগরণী টিভি” খোঁজ করলে একটি ফেসবুক পেজের সন্ধান পাওয়া যায়। নিজেদের সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচয় দেওয়া এই পেজ খুঁজে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর খোঁজ মেলে। প্রায় ২ বছর আগে, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর হুবহু একই ভিডিওর বর্ধিত সংস্করণ এই পেজে পোস্ট করা হয়। সেখানে বলা হয় “কুমিল্লায় পুলিশের ধাওয়ায় পণ্ড হয়ে যায় হরতাল সমর্থনে বিএনপির মিছিল।” অর্থাৎ, এই ভিডিওটিও বিএনপির হরতালের এবং পুরোনো, যা বর্তমানে আওয়ামী লীগের বলে ছড়ানো হচ্ছে।

৩য় ভিডিও

ফেসবুকে এদিন আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয় গাজীপুরে হরতাল পালনের দাবিতে। ৩২ সেকেন্ডের ভিডিওটি একই দাবিতে শেয়ার করতে দেখা যায় বেশকিছু আওয়ামী সমর্থিত পেজ-প্রোফাইল (, , , , , , ) থেকে। ক্যাপশনে লেখা, “হরতাল পালন হচ্ছে গাজীপুরে।” ভিডিওতে দেখা যায় একদল লোক লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় মিছিল করছে।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি যাচাইয়ে শুরুতে অনলাইনে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। যাচাইয়ে একটি ফেসবুক পোস্টে হুবহু একই দৃশ্যের ছবি পাওয়া যায়। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্টের সেই পোস্টে বলা হয় এটি বগুড়ার ঘটনা। আবার অন্য একটি পোস্টে ২০২৪ সালের ঘটনা বলা হলেও সেটি উল্লেখ করা হয় গোপালগঞ্জের। পোস্টটি শেয়ার করা হয় ৬ আগস্টে। শেয়ার করা পেজটি যাচাই করে দেখা যায় সেটির পরিচালক জি এম সাহাবউদ্দিন আজম নামের এক ব্যক্তি। নিজের পরিচয় হিসেবে তিনি সেখানে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

সূত্রটি ধরে অনলাইনে সার্চ করে ডিসমিসল্যাব প্রথম আলোর একটি ভিডিও প্রতিবেদন পায়। ৯ আগস্ট প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়– “পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ।” ওই ভিডিওতে যে ফুটেজগুলো দেখা যায় তার সঙ্গে বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে দেখতে পাওয়া একাধিক স্থাপনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ভিডিও শেয়ার করা পেজ পরিচালনাকারীকেও দেখা যায়।

তবে জায়গা সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে গুগলে লোকেশন সার্চ করে দেখে ডিসমিসল্যাব। গুগল ম্যাপে জায়গাটিকে গোপালগঞ্জের লঞ্চঘাট এলাকার বলে চিহ্নিত করে। এছাড়া গুগলের সঙ্গে ভিডিওতে থাকা কিছু স্থাপনারও হুবহু মিল পাওয়া যায়। 

এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় রাস্তায় লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল মানুষের মিছিলরত এই ভিডিওটি গাজীপুরের হরতাল পালনের নয়, কিংবা এক প্রায় এক বছর আগের বগুড়ারও নয়। বরং এটি প্রায় এক বছর আগের গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিক্ষোভ মিছিলের।

৪র্থ ভিডিও

আওয়ামী লীগের ডাকা এই হরতালের দিনে সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায় গণমাধ্যমও। চ্যানেল টুয়েন্টিফোর এদিন তাদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত শর্টসে ও অনলাইনে প্রচারিত প্রতিবেদনে এটিকে সাম্প্রতিক হরতালের বলে দাবি করে। পরবর্তীতে তারা প্রতিবেদন ও ইউটিউবের শর্টস সরিয়ে ফেললেও সরানোর আগে ভিডিওটি কেউ কেউ ডাউনলোড করে তা ফেসবুকে শেয়ার করে। এছাড়া বেশকিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী (, , , ) হরতালের দাবিতে বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা বলে একই ভিডিও শেয়ার করে।

ভিডিওটির সত্যতা যাচাইয়ে শুরুতে কিফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে “সময় টিভি” তাদের ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে একই ভিডিও প্রচার করে। এছাড়া একাধিক ফেসবুক পোস্টে (, ) একই ভিডিও পোস্ট করতে দেখা যায়। সেগুলো পোস্ট করা হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখে। তবে এগুলোর কোনোটিতেই ঘটনার বিস্তারিত বলা হয়নি।

ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে এরপর কিওয়ার্ড সার্চ করা হয়। ৩ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে “গুলিস্তানে বাসে আগুন” শিরোনামে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি অনলাইন প্রতিবেদনে বলা হয় নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দল-জোটের ডাকা নবম দফা অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয় সেদিন সকাল ছয়টায়। আর এই কর্মসূচির মধ্যে গুলিস্তানে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল।” এছাড়া সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা বলে ভিডিও ছড়াতে থাকলে সেগুলো “মিথ্যা” বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

আরো কিছু লেখা