তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন
ফাতেমা তাবাসুম
সেনাপ্রধান ও পুলিশের আইজিপির বক্তব্য দাবিতে ছড়াচ্ছে এআই দিয়ে বানানো ভিডিও
তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন
ফাতেমা তাবাসুম
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে গত ৫ আগস্ট দুটি আলাদা ভিডিও ছড়াতে দেখা যায়, যার একটিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং অপরটিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বক্তব্য দিচ্ছেন। দাবি করা হচ্ছে সেদিন জাতীয় পুলিশ হত্যা দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন তারা। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ভিডিও দুটি আসল নয়; বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি। আইজিপির পুরোনো ছবি ও সেনাপ্রধানের আগের একটি সংবাদ সম্মেলনের দৃশ্য এআইয়ের মাধ্যমে সম্পাদনা করে ভুয়া ভিডিও দুটি বানানো হয়।
প্রথম ভিডিও
গত ৫ আগস্ট ফেসবুকে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলমের ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ‘শাওন ভাইয়ের সৈনিক আমরা’ নামের প্রোফাইল থেকে ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “৫ আগস্ট পুলিশ হত্যা দিবস এই মাস আমাদের শোগর মাস শোকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে বাংলার মাটিতে পুলিশ হত্যার বিচার হবে ইনশাআল্লাহ” (বানান অপরিবর্তিত)। জানা যায়, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ভোলা-৩ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য। একই দাবিতে একাধিক ব্যবহারকারীকে (১, ২, ৩, ৪) ভিডিওটি শেয়ার করতে দেখা যায়।

ভিডিওটিতে পুলিশের পোশাকে থাকা বাহারুল আলমকে বলতে শোনা যায়, “আজ ৫ আগস্ট জাতীয় পুলিশ হত্যা দিবসে সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। হত্যার বিচার একদিন বাংলার মাটিতে হবে, কেউ রেহাই পাবে না।” মুজিব সৈনিক নামের প্রোফাইল থেকে শেয়ার করা ভিডিওটি এ পর্যন্ত সাড়ে নয়শোর বেশি শেয়ার এবং প্রায় ৬৬ হাজার বার দেখা হয়েছে।
ভিডিওটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডান কোণে ইংরেজিতে ‘ভি’ ও ‘ই’ এর কিছু অংশ, যা মূলত ‘ভিও’ (Veo) নামের একটি এআই মডেলের ওয়াটারমার্ক। ভিও হল গুগল ডিপমাইন্ডের তৈরি একটি টেক্সট-টু-ভিডিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মডেল। এটি ব্যবহার করে ছবি, লেখা বা নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা যায়।
ভিডিওটির কি-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চে দেখা যায়, সেখানে ব্যবহার করা আইজিপি বাহারুলের ফুটেজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, কালবেলা, প্রথম আলো-সহ একাধিক মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইজিপি বাহারুল আলমের একটি পুরোনো ছবির সঙ্গে মিলে যায়। ছবিটি ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে অনলাইনে পাওয়া যায়। আইজিপির বসার চেয়ার, পরনের ইউনিফর্ম, টেবিলে হাত রাখার ভঙ্গি এমনকি পিছনের রঙিন ফুলের তোড়া সবকিছু একই। এসব মিল থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, অন্তত এক বছরের পুরোনো ছবিটি ব্যবহার করেই এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে এই নতুন ভিডিও তৈরি করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর, ২০ নভেম্বর বাহারুল আলম আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান।
দ্বিতীয় ভিডিও
একই দিনে অর্থাৎ, ৫ আগস্ট ফেসবুকে শেয়ার করা আরেক ভিডিওতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি আট সেকেন্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এতে তাকে পোডিয়ামে বক্তব্য দিতে দেখা যায়, পাশে বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রথম ভিডিওটির মতো এই ভিডিওর ক্যাপশনেও দাবি করা হয়, “আজ পুলিশ হত্যা দিবস। যেদিন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে সেদিন পুলিশ হত্যার বিচার হবে ইনশাল্লাহ।” একই দাবিতে এটি একাধিক ফেসবুক প্রোফাইল, পেজ ও গ্রুপে শেয়ার হয়। এর মধ্যে ‘একাওর এর চেতনা’ নামের একটি প্রোফাইল থেকে চার লাখের বেশি ব্যবহারকারীদের গ্রুপ ‘Supporters of Bangladesh Awami League (সাপোর্টার্স অফ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ)’-এও ভিডিওটি পোস্ট করা হয়, যা এ পর্যন্ত ফেসবুকে ৪৯ হাজারের বেশিবার দেখা হয়েছে।

ভিডিওটিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে বলতে শোনা যায়, “আজ পাঁচ আগস্ট পুলিশ হত্যা দিবস উপলক্ষে সকল শহীদ পুলিশ ভাইদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।” তবে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এর প্রায় সাত সেকেন্ড পর সেনাপ্রধানের পাশাপাশি এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান- তিনজনের মুখ একই সময়ে অস্পষ্ট ও ঝাপসা হয়ে আসে। মুখের অস্পষ্টতা থেকে ভিডিওটি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে তৈরি সে ধারণা মেলে। সাধারণত, এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি ভিডিওতে এমন অস্পষ্টতা, মুখের অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা ঝাপসা ভাব লক্ষ্য করা যায়।

ভিডিওটির কি-ফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আট সেকেন্ডের শুরুর ওই ফ্রেমটি ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট বাংলাদেশ আর্মির ভেরিফায়েড পেজে শেয়ার করা একটি ছবির সঙ্গে হুবুহু মিলে যায়। ছবিটি মূলত এক বছর আগের, গত বছরের ৫ আগস্ট, সাবেক সরকার পতনের পর অনুষ্ঠিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রেস ব্রিফিং’-এর একটি দৃশ্য। ওই ছবিতে সেনাপ্রধান, নৌবাহিনী প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান দাঁড়িয়ে আছেন। সেনাপ্রধানের সামনে থাকা মাইক বা বুমের সংখ্যা ও অবস্থানও ভিডিওর ওই অংশের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
এসব তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট সেনাপ্রধানের ‘পুলিশ হত্যা দিবস’ উপলক্ষে দেওয়া কোনো বক্তব্যের দৃশ্য এটি নয়, বরং ঠিক এক বছর পুরোনো সংবাদ সম্মেলনের ছবি-ভিডিও ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

গুগলের ভিও এআই বা অন্য এআই টুল ব্যবহার করে তৈরি ভিডিও ভুয়া দাবিতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের ঘটনা এই প্রথম নয়। ডিসমিসল্যাবে ইতোমধ্যেই ভিও-থ্রি জেনারেটেড ভিডিও নিয়ে একটি ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গুগলের ভিও-থ্রি হল গুগল ডিপমাইন্ডের তৈরি সর্বশেষ ও অত্যাধুনিক এআই ভিডিও জেনারেশন মডেল। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছবি ও টেক্সট (প্রম্পট) ব্যবহার করে বাস্তব সদৃশ কৃত্রিম ভিডিও তৈরি করা যায়। ভিও-থ্রির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর নেটিভ অডিও জেনারেশন ক্ষমতা, যা ভিডিওর সঙ্গে মানানসই সংলাপ, ভয়েস-ওভার, বিভিন্ন সাউন্ড ইফেক্ট এবং আবহ সংগীত স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করে, যাতে ভিডিওর ভিজ্যুয়ালের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য থাকে।