তৌহিদুল ইসলাম রাসো
পুরোনো তালিকাকে সাম্প্রতিক দাবি: বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
সম্প্রতি বিশ্বের শক্তিশালী দেশের তালিকা নিয়ে একাধিক বিভ্রান্তি ছড়াতে দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। ফেসবুকে গ্রাফিক কার্ড শেয়ার করে ইউ.এস. নিউজের বরাতে বলা হচ্ছে, ২০২৫ সালে শক্তিশালী দেশের তালিকায় ১২৩তম স্থান থেকে ৪৭তম অবস্থানে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। আবার কোথাও বলা হচ্ছে তালিকায় বাংলাদেশ আগে ৪০তম অবস্থানে ছিল, এখন পিছিয়ে ৪৭তম হয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে একাধিক সংবাদমাধ্যমেও। তবে যাচাইয়ে দেখা গেছে তালিকাটি ২০২৫ সালের নয়। শক্তিশালী দেশের এই তালিকা ২০২৪ সালের। অর্থাৎ, এক বছর আগের শক্তিশালী দেশের তালিকাকে বর্তমানের বলে ছড়ানো হচ্ছে। ইউ.এস. নিউজ ওয়েবসাইট যাচাইয়ে দেখা গেছে সেখানে ২০২৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও স্থিতিশীল দেশ নামের আলাদা দুটি তালিকা প্রকাশিত হলেও শক্তিশালী দেশের র্যাঙ্কিং পাওয়া যায়নি।
চলতি বছরে শক্তিশালী দেশের এই তালিকা নিয়ে প্রথম পোস্টটি ডিসমিসল্যাব দেখতে পায় “বেঙ্গলিভার্স” (BengaliVerse) নামের একটি ফেসবুক পেজে। নিজেদের নিউজ ও মিডিয়া ওয়েবসাইট বলে পরিচয় দেওয়া এই পেজ থেকে ৮ মার্চ দুপুর ১টা ৪৬ মিনিটে এ সম্পর্কিত পোস্ট করা হয়। কার্ডে লেখা ইংরেজি তথ্যের বাংলা অর্থ দাড়ায়, “১২৩ থেকে ৪৭: ২০২৫ সালে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৭তম শক্তিশালী দেশ।” পোস্টের বিবরণে লেখা, “ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৭তম শক্তিশালী দেশ।”
ঘণ্টাখানেক পর দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে আগের কার্ডটি সরিয়ে দিয়ে নতুন আরেকটি কার্ড যুক্ত করে তারা। এবার বিবরণ একই রেখে নতুন ছবি যুক্ত করা হয়। এই ছবিতে লেখা হয়েছে, “২০২৫ সালে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৭তম শক্তিশালী দেশ।” এখন পর্যন্ত পোস্টটি শেয়ার করা হয়েছে ১০ হাজারের বেশিবার, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ১১ হাজারের বেশি ব্যবহারকারী। পোস্টে মন্তব্য জানিয়েছেন প্রায় ৭০০ জন। মন্তব্যে উক্ত পেজ থেকেই তথ্যের সূত্র হিসেবে ইউ.এস. নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের লিঙ্ক শেয়ার করা হয়েছে। এছাড়া সেখানে আলাদা কমেন্টে একটি কার্ড যুক্ত করে সেখানে শক্তিশালী দেশের তালিকার প্রথম ৫০টি দেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

এরই মধ্যে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী বেঙ্গলিভার্সের আগের কার্ড (১, ২, ৩) নতুন করে আপলোড করা শুরু করেন। কেউ কেউ সেটির সঙ্গে ৫০টি দেশের তালিকাযুক্ত কার্ডটিও শেয়ার (১, ২, ৩) করেন। এছাড়া একই তথ্য জানিয়ে আলাদা একটি কার্ড নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে শেয়ার করেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। একই দাবিতে ভিন্ন ভিন্ন (১, ২, ৩) কার্ড পোস্ট করা হয় ফেসবুকে। এছাড়া একই তথ্য শেয়ার করেন এক্সের (১, ২, ৩, ৪) অনেক ব্যবহারকারী।
পাল্টা দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু পোস্টে (১, ২, ৩) বলা হয়, তালিকায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ছিল ৪০তম অবস্থানে এবং ২০২৫ সালে হয়েছে ৪৭তম।

সামাজিক মাধ্যমের এই বিভ্রান্তিকর দাবি এরপর চলে আসে একাধিক (১, ২, ৩) মূলধারার গণমাধ্যমেও। তবে একেক গণমাধ্যমে করা হয় একেক ধরনের দাবি। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ১১২তম থেকে ৪৭তম অবস্থানে উঠে এসেছে। জুমবাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৭তম অবস্থানে এসেছে ১২৩তম স্থান থেকে। আর প্রথম আলো তাদের প্রতিবেদনে এটি কোন সালের র্যাঙ্কিং– তা উল্লেখ করেনি। তবে তারা বলেছে বাংলাদেশ ১৯৫টি দেশের মধ্যে শক্তিশালীর তালিকায় ৪৭তম হয়েছে।

আলোচিত র্যাঙ্কিংয়ের সত্যতা খুঁজতে মার্কিন গণমাধ্যম ইউ.এস. নিউজ– এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে দেখে ডিসমিসল্যাব। সেখানে দেখা যায় এই র্যাঙ্কিংটি ২০২৫ সালের নয়, বরং ২০২৪ সালের। এবং এই র্যাঙ্কিংটি করা হয়েছিল ৮৯টি দেশকে নিয়ে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল সেই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর। আর র্যাঙ্কিংয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০২৪ সালের ২২ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত। গত বছরের ওই র্যাঙ্কিংয়ে শক্তিশালী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল ৪৭তম অবস্থানে। আর সামগ্রিকভাবে ছিল ৭১তম অবস্থানে।
শক্তিশালী দেশের র্যাঙ্কিংয়ে একাধিক বিষয় বিবেচনায় নেয় ইউ.এস. নিউজ। মার্কিন এই গণমাধ্যমটি বলছে, “বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোই হল সেগুলো তারাই যারা নিয়মিতভাবে সংবাদ শিরোনামে আধিপত্য বিস্তার করে, নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ধারা গঠনে ভূমিকা রাখে। তাদের পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক বাজেট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।” এছাড়া এই র্যাঙ্কিংটি আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে যা গণমাধ্যমটির সেরা দেশ নির্বাচনের পদ্ধতি অংশে আরও বিস্তারিত বলা আছে।

বেঙ্গলিভার্সের প্রথম কার্ডের যে দাবিটি করা হয়েছিল সেটিও যাচাই করে ডিসমিসল্যাব। সেখানে বলা হয়েছিল শক্তিশালী দেশের তালিকায় ১২৩ থেকে ৪৭তম অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। এই তথ্য যাচাইয়ের জন্য আগের বছরের র্যঙ্কিংও খুঁজে বের করা হয়। ২০২৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এটি প্রকাশ করেছিল এই মার্কিন গণমাধ্যম। ওই বছরে ৮৭টি দেশকে নিয়ে এই জরিপটি করা হয়েছিল।
সেখানে দেখা যায় ২০২৩ সালে এই গণমাধ্যমের সেরা দেশের সামগ্রিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ৬৯তম অবস্থানে আর শক্তিশালী দেশের তালিকায় ছিল ৪০তম অবস্থানে। আর ২০২৪ সালের র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ সামগ্রিক র্যাঙ্কিংয়ে হয় ৭১তম আর শক্তিশালী দেশের তালিকায় হয় ৪৭তম। অর্থাৎ, সেরা দেশের সামগ্রিক র্যাঙ্কিংয়ে ও শক্তিশালী দেশের তালিকায় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অবনতি ঘটলেও এর সঙ্গে অন্তর্বতীকালীন সরকারের সময়কার কোনো সম্পর্ক নেই। দুটি র্যাঙ্কিংই প্রকাশিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে।
অর্থাৎ, বাংলাদেশকে ১২৩তম স্থান থেকে ৪৭তম অবস্থানে এসেছে বলে দাবি করা হলেও, এটি ভিত্তিহীন। কারণ, বাংলাদেশ প্রথমবার র্যাঙ্কিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হয় ২০২২ সালে, যখন তালিকায় দেশ ছিল মাত্র ৮৫টি। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে ৮৭টি ও ২০২৪ সালে ৮৯টি। ফলে বাংলাদেশের ১২৩তম অবস্থানে থাকার কোনো সুযোগই ছিল না। অপরদিকে প্রথম আলোর দাবিতে ১৯৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৭তম বলা হলেও সেটিও সম্ভব নয় কারণ বাংলাদেশ যে তিনবার তালিকায় এসেছে সেখানে বিবেচনায় নেওয়া দেশের সংখ্যা কখনোই একশোর বেশি ছিল না।
এছাড়া চলতি বছরে দেশ নিয়ে কোনো র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়েছে কি না তা যাচাই করতে গিয়ে দুটি আলাদা প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯ মার্চের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি স্থিতিশীল দেশের তালিকা নিয়ে আর পরেরদিন ২০ মার্চের প্রতিবেদনটি সুখী দেশের তালিকা নিয়ে।