ফাতেমা তাবাসুম

বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যের আহ্বান জানানো গুনথার ন্যাটোর কেউ নন
ফাতেমা তাবাসুম
ভারতকে আর প্রয়োজন নেই, বরং মুক্ত বাণিজ্যে বাংলাদেশকে চাইছেন ন্যাটোর অস্ট্রিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান গুনথার ফেলিংগার, এমন দাবিতে সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশ করেছে একাধিক গণমাধ্যম। একই দাবি ছড়াতে দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমের একাধিক পোস্টেও। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, ফেলিংগার ন্যাটোর কোনো কর্মকর্তা নন। এছাড়া অস্ট্রিয়াও ন্যাটোর সদস্য নয় এবং ‘ন্যাটোর অস্ট্রিয়া বিভাগ’ নামে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা নেই। ফেলিংগার মূলত ন্যাটো সম্প্রসারণের পক্ষে সক্রিয় একজন অ্যাক্টিভিস্ট। সামাজিক মাধ্যমে তিনি নিজেকে ‘অস্ট্রিয়ান কমিটি ফর ন্যাটো এনলার্জমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান পরিচয় দিলেও এটি কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান নয়, বরং তার ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত একটি উদ্যোগ।
“আমাদের ভারতের প্রয়োজন নেই, বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি চাই: গুনথার” এই শিরোনামে বাংলাদেশি গণমাধ্যম ‘একাত্তর টিভি’ গত ০৭ সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন ন্যাটোর অস্ট্রিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান গুনথার ফেলিংগার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি পোস্ট করে নিজের এই মতামত তুলে ধরেন গুনথার।”

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “এর আগে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আলাদা আলাদা নামকরণ করে এবং পতাকা দিয়ে একটি মানচিত্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন ন্যাটোর প্রভাবশালী এই নেতা। তার ওই মানচিত্র নিয়ে বিভিন্ন দেশে আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যখন একেবারেই তলানিতে তখন ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ এই নেতার এমন অবস্থান ভারতকে আরো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।”
একাত্তর টিভি তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একই দিনে “আমাদের ভারতের প্রয়োজন নেই, বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি চাই: গুনথার” শীর্ষক একটি ফটোকার্ডও প্রকাশ করেছে। এরপর ফেসবুকে ‘একাত্তর টিভি’র বরাত দিয়ে একাধিক পোস্ট (১, ২, ৩) শেয়ার হতে দেখা যায়। ‘একাত্তর টিভি’ ছাড়াও ‘বিডি মর্নিং ডট কম,’ ‘দুরবিন নিউজ’ ও ‘আলভি’স ওয়ার্ল্ড’ নামের অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজ থেকেও গুনথারকে ন্যাটোর অস্ট্রিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান দাবিতে ফটোকার্ড ছড়াতে দেখা গেছে। গুনথারের যেই টুইটকে কেন্দ্র করে এই খবর প্রকাশ করা হয়েছিল, সেই টুইটের স্ক্রিনশটও যুক্ত করা হয়েছে একাধিক পোস্টে (১, ২, ৩)।
কি-ওয়ার্ড সার্চে এক্সে ‘গুনথার ফেলিংগার’ নামের ভেরিফায়েড হ্যান্ডল থেকে ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পোস্টটিও শনাক্ত করে ডিসমিসল্যাব। ‘গুনথার ফেলিংগার ইয়ান’ নামের এই এক্স হ্যান্ডলের বায়োতে দাবি করা হয়েছে, তিনি “অস্ট্রিয়ান কমিটি ফর ন্যাটো এনলার্জমেন্টের চেয়ারম্যান”।

গুনথারের নাম অনুসন্ধানে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ২০২৩ সালের একটি ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। সেসময় গুনথার নিজেকে ‘ইউরোপীয় কমিটি ফর ন্যাটো এনলার্জমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান দাবি করতেন। রয়টার্স জানায়, গুনথার ফেলিংগারের সঙ্গে মার্কিন সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। তিনি কেবল ন্যাটোতে নতুন দেশ অন্তর্ভুক্তির পক্ষে থাকা একটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। সেসময় গণমাধ্যমকে দেয়া ন্যাটোর এক বিবৃতিতে সামরিক জোটটি নিশ্চিত করেছিল যে, “ফেলিংগারের সঙ্গে সংস্থাটির কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।” এছাড়াও গুনথার ফেলিংগার নিজেই রয়টার্সকে একটি ইমেইলে জানান, “ন্যাটোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার কোনো টুইটই আনুষ্ঠানিক অবস্থান প্রকাশ করে না।”
এছাড়াও গুনথার ২০২৩ সালে তার এক টুইটে লিখেছিলেন, “আমি স্বীকার করছি, ইউরোপীয় কমিটি ফর ন্যাটো এনলার্জমেন্ট আসলে শুধু আমিই!” সেসময় ন্যাটোর সদর দফতরের পাবলিক ডিপ্লোমেসি ডিভিশনের প্রেস এবং মিডিয়া সেকশনের প্রেস অফিসার দানিয়েলে রিজিও মিডিয়াকে নিশ্চিত করেন যে, ফেলিংগারের ন্যাটোর সাথে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।

একই সময় জর্জিয়া ভিত্তিক তথ্য যাচাইকারী সংস্থা ‘মিথ ডিটেক্টর’ ও আর্মেনিয়া ভিত্তিক তথ্য যাচাইকারী সংস্থা ‘ফ্যাক্ট ইনভেস্টিগেশন প্ল্যাটফর্ম’-ও জানায়, গুনথার ফেলিংগার নর্থ আটলান্টিক অ্যালায়েন্সে কোনো পদধারী নন এবং জোটের কাঠামোর মধ্যে ন্যাটো সম্প্রসারণের জন্য কোনো ইউরোপীয় কমিটি নেই।
প্রসঙ্গত, ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একটি রাজনৈতিক ও সামরিক জোট, যা গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সম্মিলিত প্রতিরক্ষা। তবে, অস্ট্রিয়া ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে অস্ট্রিয়া ন্যাটোর সঙ্গে পার্টনারশিপ ফর পিস (Partnership for Peace) কর্মসূচির মাধ্যমে কিছু সহযোগিতা করে। অর্থাৎ, অস্ট্রিয়া সহযোগী দেশ, কিন্তু ন্যাটোর পূর্ণাঙ্গ সদস্য নয়।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ভারতের প্রেসিডেন্ট নরেন্দ্র মোদির সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান ও সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠককে ঘিরে গুনথার ফেলিংগারের হ্যান্ডেলে একাধিক টুইট (১, ২, ৩, ৪) দেখা যায়। এর মধ্যে, ৫ সেপ্টেম্বর গুনথার ফেলিংগারের এক্স হ্যান্ডেলে একটি বিতর্কিত টুইটে তিনি ভারত ভাঙার আহ্বান জানিয়ে এবং খালিস্তানের মানচিত্র শেয়ার করে লেখেন, “আমি ভারতকে ভেঙে এক্স ইন্ডিয়া করার আহ্বান জানাচ্ছি। নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার মানুষ। খালিস্তানের স্বাধীনতার বন্ধু প্রয়োজন আমাদের”।
ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন (১, ২, ৩) হতে জানা যায়, দেশটির স্বরাষ্ট্র এবং ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গুনথার ফেলিংগারের হ্যান্ডেলের এই ভাইরাল পোস্টটি আইনি নোটিশের ভিত্তিতে ‘ফ্ল্যাগড’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ভারতের ব্যবহারকারীরা যেন এই অ্যাকাউন্ট দেখতে না পারে, সে পদক্ষেপও নিতে বলে এক্সকে। বর্তমানে ভারত থেকে এই অ্যাকাউন্ট দেখা যাচ্ছে না।
ভারত নিয়ে গুনথারের বিতর্কিত বক্তব্যের রেশ না কাটতেই বাংলাদেশ নিয়ে আলোচিত পোস্টটি করেন গুনথার। এই পোস্টের ভিত্তিতেই “বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আহ্বান জানিয়েছে ন্যাটোর অস্ট্রিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান” শীর্ষক খবর দেশীয় গণমাধ্যমে ছাপানো হয়। এর আগে বিভিন্ন বিতর্কিত পোস্টের জন্য সমালোচিত এবং এক্স কর্তৃক ফ্ল্যাগড হওয়ার ঘটনা ঘটলেও, এই পোস্টটিকে সূত্র ধরে বাংলাদেশি গণমাধ্যমে তাকে ‘ন্যাটোর অস্ট্রিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান’ উল্লেখ করে খবর প্রকাশ করে।