তামারা ইয়াসমীন তমা
জার্মানিতে মুসলিম শিশুকে পুলিশের নিয়ে যাওয়ার ভাইরাল ভিডিও সম্পর্কে যা জানা গেল
তামারা ইয়াসমীন তমা
জার্মানিতে ছোট একটি শিশুকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফ্রন্টিয়ার ডেইলি নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ২৯ এপ্রিল আপলোড করা ৪ মিনিট ১২ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট একটি শিশুকে পুলিশের পোশাক এবং সাদা পোশাকধারী কয়েকজন মিলে জোর করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২৬ হাজারের বেশিবার শেয়ার হওয়া ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “সন্তান স্কুলে গিয়ে বলেছে, তার বাবা-মা বলেছেন, সমকামিতা ইসলামে হারাম। তাই তাকে বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে জার্মান প্রশাসন।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি আরও কয়েক জায়গায় ছড়াতে দেখা গেছে। এবং প্রতিটি পোস্টেই (১, ২, ৩, ৪) একই দাবি করা হচ্ছে। গত ২৯ এপ্রিল ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্মার্ট নিউজ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলেও। সেখানেও এই ঘটনার নেপথ্য কারণ হিসেবে একই রকম দাবি প্রচার করা হয়েছে।
তবে কারেক্টিভ ফ্যাক্টেনচেক ও মিমিকামা-র মতো জার্মান ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাগুলো বলছে, ভাইরাল ভিডিওটির সঙ্গে সমকামিতা বিষয়ক কোনো বিতর্কের যোগসূত্র নেই।
এ বিষয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যম কারেক্টিভ ফ্যাক্টেনচেক ও ভকসভারপেটজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ভিডিওটি কেন্দ্র করে ভুয়া খবর প্রচারিত হচ্ছে। জার্মান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক বেঞ্জামিন হিন্ডরিকস জানান, “ভিডিওর ঘটনাটি সত্য। তবে এর সঙ্গে এলজিবিটি ইস্যুর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই”।
ভিডিওটিতে যা দেখা যাচ্ছে
তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪ মিনিট ১২ সেকেন্ডের ভিডিওটি আরবি ভাষাভাষী এক ব্যক্তি ধারণ করেছেন। সেখানে ছোট শিশুটিকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার সময় ভয়ে সে চিৎকার করে কাঁদছে এবং নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। একই সময় শিশুটির পরিবার পুলিশের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছে। এসময় একজন পুলিশ অফিসারকে বলতে শোনা যায়, “এটি আদালত এবং ইয়ুথ ওয়েলফেয়ার অফিসের সিদ্ধান্ত এবং তারা আদালতের নির্দেশ পালন করছেন।”
পুলিশ যা বলছে
জার্মানির ব্রেমারহ্যাভেন পুলিশ ঘটনাটি সঠিক বলে গত ২৯ এপ্রিল একটি বিবৃতি জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, “ব্রেমারহ্যাভেন পুলিশ ও ইয়ুথ ওয়েলফেয়ার অফিসের যৌথ অভিযানের একটি ভিডিও ভুয়া দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এটি আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী দুই শিশুর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণকালে ধারণকৃত একটি ভিডিওর ছোট অংশ। পুলিশ এই অভিযানে ইয়ুথ ওয়েলফেয়ার অফিসকে সহায়তা করেছে। শিশুদের তত্ত্বাবধান গ্রহণ সব সময়ই সর্বশেষ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে নেওয়া হয়ে থাকে এবং কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কারণেই এমনটা করা হয়ে থাকে।”
পরবর্তীতে ব্রেমারহ্যাভেন পুলিশের একজন মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা ডিপিএকে নিশ্চিত করেন যে, এই ভিডিওর সঙ্গে কারো পারিবারিক বা লিঙ্গগত পরিচয় সংক্রান্ত শিক্ষার সম্পর্ক নেই। তারা বলেন, “আমরা এটি অস্বীকার করতে পারি, অবশ্যই এটি সত্য নয়।”
পরবর্তীতে, ব্রেমারহ্যাভেন শহর কর্তৃপক্ষকে ইয়ুথ ওয়েলফেয়ার অফিসের অভিযান ও ভিডিওটির সত্যতার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে শহরের প্রেস অফিসের মুখপাত্র মার্ক শ্রোডার এক ইমেইলে কারেক্টিভ ফ্যাক্টেনচেককে জানান, ভিডিওটি সত্য এবং এটি ২৪ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ের ঘটনা। তবে তিনি এও জানান, “ভিডিওটির সঙ্গে হোমোফোবিয়ার সংশ্লিষ্টতার কথা প্রচারিত হলেও তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।”
ভিডিওটি যেভাবে ছড়িয়েছে
স্থানীয় পত্রিকা নর্থসি জেইটাং-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিশুদের নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারটি মুসলিম বন্ধুমহলে ভিডিওটি শেয়ার করে এবং দ্রুতই তা বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে।
২৭ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার একজন সাংবাদিক তার সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলে ভিডিওটি প্রকাশ করেন। এখান থেকেই তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২৮ এপ্রিল ব্রিটিশ বেসরকারি একটি ব্রডকাস্টের মর্নিং শো প্রোগ্রামের উপস্থাপক ভিডিওটি শেয়ার করেন টুইটারে। সেখানে তিনি কোনো সূত্রের উল্লেখ না করেই বলেন, “একটি শিশুকে জোর করে তার পরিবার থেকে সরিয়ে নিচ্ছে ইয়ুথ প্রটেকশন সার্ভিস ও পুলিশ। শিশুটির স্কুল জানতে পারে তাকে শেখানো হয়েছে যে, সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের শিশুদের রক্ষা করুন”। এরপরেই ভিডিওটি আরও বিভিন্ন জায়গায় ছড়াতে শুরু করে।
এলজিবিটি কমিউনিটির বিরুদ্ধে ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইন
দীর্ঘদিন ধরেই ডিজিটাল হয়রানির শিকার হয়ে আসছে এলজিবিটি কমিউনিটির সদস্যরা। ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইনস অ্যাবাউট এলজিবিটিআই+ পিপল ইন দ্য ইইউ অ্যান্ড ফরেন ইনফ্লুয়েন্স শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, সামাজিক মেরুকরণ তৈরির মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইউরোপীয়দের মাঝে ইচ্ছা করেই এলজিবিটির মতো কমিউনিটিগুলো নিয়ে মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে।
সোশ্যাল সার্ভিসের নামে সন্তানদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা
২০১২ সালে সেক্রেটারি জেনারেল অব দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপের কাছে লেখা এক চিঠিতে সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো বিভিন্ন নর্ডিক দেশে অভিবাসী, তরুণ, একক অভিভাবক এবং অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলো থেকে সোশ্যাল সার্ভিসের নামে নির্মমভাবে শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার নিন্দা জানায় নর্ডিক কমিটি ফর হিউম্যান রাইটস (এনএইচসিআর)।
চিঠিতে আরও বলা হয়, “রাজনৈতিকভাবে সমর্থিত নয় এমন ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাসী বাবা-মায়েরাও প্রায়ই অভিভাবক হিসেবে অনুপযুক্ত বিবেচিত হন।”