নোশিন তাবাসসুম

ভিডিও ছড়াচ্ছে শেখ হাসিনার রায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে, আসলে দেওয়া হচ্ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ
নোশিন তাবাসসুম
সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দায়ের করা মামলার মধ্যে ২টি মামলার রায় শেখ হাসিনার পক্ষে এসেছে, বাকিগুলো চলমান আছে। এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতের যে রায় ঘোষণা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে এই রায়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকে দেখা যায়, ভিডিওটি আসলে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারিতে জুলাই আন্দোলন সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ওপর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন উপস্থাপনের কিছু অংশ, এবং দাবির সঙ্গে ভিডিওটির কোনো সম্পর্ক নেই।
ফেসবুকের একটি ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে বলা হয়, “আলহামদুলিল্লাহ 🤲 ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দায়ের করা মামলার মধ্যে ২টি মামলার রায় শেখ হাসিনার পক্ষে এসেছে, বাকিগুলো চলমান রয়েছে। এছাড়া নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবৈধ আন্তর্জাতিক আদালতের যে রায় রায় ঘোষণা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এসবে জড়িতদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত দ্রুত ব্যবস্থা নিবে বলে জানিয়েছেন।” এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভিডিওটি প্রায় ৪০ হাজার বার দেখা হয়েছে এবং ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছে ৯১৯ বার। ফেসবুকের বেশকিছু ব্যক্তিগত প্রোফাইলে (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬) একই দাবিতে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়।

১ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের ভিডিওতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে বক্তব্য প্রদান করতে দেখা যায়। ফলকার টুর্কের পেছনে জাতিসংঘের লোগোর অংশবিশেষ দেখা যায়। ভিডিওতে ফলকার টুর্ককে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার ব্যবস্থা, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা, এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়।
ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ে ভিডিওটির কিফ্রেম ধরে সার্চ করলে, চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দ্য ইনফরমিকার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হুবহু একই ফুটেজের একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ক্যাপশনে লেখা, “ওএইচসিএইচআর – প্রেস কনফারেন্স: বাংলাদেশের বিক্ষোভের উপর তথ্যানুসন্ধানপ্রতিবেদন।” ৫২ মিনিট ১০ সেকেন্ড দীর্ঘ ভিডিওর ২২ মিনিট ১৩ সেকেন্ড থেকে ২২ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড, ১ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ড, এবং ২ মিনিট ৩০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির হুবহু মিল আছে।
ভিডিওতে ফলকার টুর্ক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলেন। ভিডিওর কোথাও টুর্ককে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর দাবি অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় বা ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে চলমান মামলা নিয়ে কিছু বলতে দেখা যায়নি।
এ ঘটনা নিয়ে অধিকতর যাচাই করলে ওএইচসিএইচআর এর ওয়েবসাইটে ১২ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রেস রিলিজ পাওয়া যায়। যেখানে এই প্রতিবেদন প্রকাশের তথ্য তুলে ধরা হয়। এই প্রেস রিলিজ থেকে সংস্থাটি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
এছাড়া এই তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে একাধিক (১, ২, ৩) গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ বিষয় নিয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছিল: ফলকার টুর্ক” প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের জনগণের বিরোধিতার মুখেও ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল সাবেক সরকার। আর সে লক্ষ্য পূরণে বিক্ষোভ দমন করার কৌশল নিয়েছিল তারা। এর অংশ হিসেবে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার গ্রেপ্তার-আটক ও নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এমন অভিমত দিয়েছেন।”
অর্থাৎ, সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে যে ভিডিওটি প্রচারিত হয়েছে সেটি ফেব্রুয়ারিতে জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ওপর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানপ্রতিবেদন উপস্থাপনের ভিডিওর খন্ডচিত্র।

